আমাদের চকবাজার লাগবে, রমনা পার্কও লাগবে

>
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে আমরা বলি আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। কারণ, তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি মানুষকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। বইমেলার মাসে তাঁর একটি বক্তৃতা আজ থাকল স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের জন্য। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল স্কুল ও কলেজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, কেন বই পড়া মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

ছোট ছোট ছাত্রবন্ধুরা,

ছাত্রদের আগে আমি বন্ধু বলেই সম্বোধন করতাম—এখন সাহস হয় না। ভয় লাগে হয়তো বলে বসবে: আপনি বুড়ো হয়ে আমাদের বন্ধু বলেন? আপনার আস্পর্ধা তো কম নয়? 

...তোমরা তো আমাদের বইপড়া কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আজ পুরস্কার পেতে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এই কর্মসূচি আমরা করি; কেন দেশ-বিদেশের মজার মজার বই, সুন্দর সুন্দর বই, স্বপ্নের মতো বই তোমাদের পড়তে দিই, এসো এবার সে সম্বন্ধে কিছু বলি। প্রথমে তোমরা আমাকে বলো, তোমরা ক্লাসে যেসব পাঠ্যবই পড়ো, সেগুলো তোমাদের পড়ার দরকার আছে কী নেই?

 [ছাত্ররা: আছে।]

নিশ্চয় আছে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে, মর্যাদার জীবন পেতে হলে, ওই সব বই আমাদের পড়তেই হবে। যদি আমরা এসব বই ঠিকমতো না পড়ি—তাহলে আমরা কোনো দিন আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হব না। মানব সভ্যতাকেও এগিয়ে নিতে পারব না। আমাদের বেঁচে থাকাটাই ছোট হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, ওটা আমাদের করতেই হবে। বিশেষ করে তোমাদের মতো এমন ছবির মতো সুন্দর আর পরিপাটি একটা স্কুলে যদি পড়ার কারও সৌভাগ্য হয় তবে তো এ আরও বেশি করে করতে হবে।

পাঠ্যবই তো তোমাদের তাই পড়তেই হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি কিছু অপাঠ্য বইও আবার পড়া দরকার। দিনের সঙ্গে রাত যেমন দরকার, রাজবাড়ির সঙ্গে সরোবর যেমন দরকার, তেমনি। পাঠ্যপুস্তক পড়ে তোমরা সুশিক্ষিত হবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, বৈষয়িক জীবনকে জয় করবে। আর এই যে বাইরের বই, যেগুলোকে অনেকে অপাঠ্য মনে করে দূরে সরিয়ে দেন—এগুলো পড়লে তোমাদের মন বিকশিত হবে। ভেতরের স্বপ্নগুলো বড় হবে। তোমরা আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।

মৌলভীবাজার নামে ঢাকায় একটা জায়গা আছে জানো? কোথায় বলো তো?

 [একজন ছাত্র: পুরোনো ঢাকায়।]

ঠিক বলেছ, পুরোনো ঢাকায়। সেখানে কী হয় জানো? সে এক অদ্ভুত ব্যস্ততার জগৎ। সেখান থেকে ঢাকা মহানগরীর যাবতীয় চাল, ডাল, গম, তেল, আলু, মসলার চালান আসে। তাই সেখানে আছে গুদাম আড়ত, হাজারো কেনাবেচার ব্যবস্থা। সেখানে অনেক কাজ, ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি আর ঠাসাঠাসি; মানুষ-গাড়ি-জিনিসপত্রের বিকট শব্দে উত্তেজনায় দম আটকানো অবস্থা। তোমরা সেখানে গেলে দেখবে সেই অন্ধকার গলিঘুঁজিওয়ালা ঘিঞ্জি জায়গায় তোমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে। ভিড়ের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে।

এবার বলো তো, এই জায়গাটার দরকার আমাদের আছে, না নেই? আমি বলব, নিশ্চয়ই আছে। এ জায়গা থেকে যদি চার-পাঁচ দিনের জন্যও আমাদের চাল-ডাল, নুন-তেল বা প্রতিদিনের দরকারি জিনিসপত্রগুলো না আসত তাহলে কি ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদই না আমাদের শুরু হয়ে যেত। এই মিলনায়তনে এমন দার্শনিকের মতো গাম্ভীর্য নিয়ে তোমরা বসে থাকতে পারতে না। পেট চোঁ চোঁ করত। জ্ঞানচর্চা শিকেয় উঠত। খাবারের জন্য এতক্ষণ ছোটাছুটি শুরু করতে। তাই আমাদের প্রথম কাজ বেঁচে থাকা। ভালোভাবে, সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকা। তারপরে বিকাশ: বড় হওয়া, সমৃদ্ধ হওয়া।

তাই ঢাকা শহরে কেবল মৌলভীবাজার চকবাজার নেই, এদের মতোই আরেকটা জায়গা আছে, এসো এবার তাদের দিকে তাকাই। জায়গাগুলো চকবাজার মৌলভীবাজারের ঠিক উল্টো। মৌলভীবাজার যেমন সারাক্ষণ কাজে শ্রমে ঘামে জ্যাবজেবে, ওগুলোতে তেমনি আবার কোনো কাজই নেই। কোন জায়গা বলো তো এটা? বলো তো, ঢাকা শহরে এমন কী কোনো জায়গা আছে, যেখানে কাজ নেই? কেবল সারবাঁধা গাছপালা আর বসে বসে গল্প।

[একজন ছাত্র: রমনা পার্ক।]

ঠিক বলেছ, রমনা পার্ক। মানুষের কোনো কাজ নেই ওখানে! মানুষ সেখানে অযথাই বসে থাকে, গল্প করে, চিনাবাদাম খায়, ঘুরে বেড়ায়, প্রেম করে। আলসেমিতে, অবসরে, অর্থহীন আনন্দে সময় কাটানোর জন্য যায়। জীবনের বাস্তবতা থেকে দূরে নীল আকাশের নিচে সবুজের রাজ্যে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়। তো, এখন তোমরা বলো, ঢাকা শহরে শুধু মৌলভীবাজার চকবাজার থাকলেই কি চলবে? নাকি রমনা পার্কও থাকতে হবে?

 [সবাই: রমনা পার্কও থাকতে হবে।]

কেন থাকতে হবে? কারণ, কেবল কোনোমতে টিকে থাকলেই আমাদের চলে না, আমাদের পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে হয়। কী কাজ হয় রমনা পার্ক-চন্দ্রিমা উদ্যান দিয়ে? এসো এবার তাই নিয়ে কথা বলি। বেঁচে থাকার জন্য মৌলভীবাজারের যেমন দরকার, তেমনি মনের আনন্দের জন্য, সম্পন্ন জীবনের জন্য দরকার রমনা পার্কেরও। দুটোর কোনোটা না হলেই হয় না। কেন দুটোই দরকার, এই কথাটা এবার বুঝিয়ে বলি। যে জিনিস যত বেশি কাজ করে, গায়ে খাটে, পরিশ্রম করে, তার চেহারা তত কদাকার হয়ে পড়ে। যেমন বিশাল বিশাল ট্রাক। সারা দিন গোঁ গোঁ করে মাল টানছে, পশুর মতো খাটছে। সবই আছে তাদের, টাকাপয়সাও রোজগার অনেক। কিন্তু একটা জায়গাতে এরা অভিশপ্ত। ওরা দেখতে বড় কদাকার আর বদখত। একেবারেই সুন্দর না। যাকে খুব বেশি শরীরের খাটনি খাটতে হয়, তার সৌন্দর্য মরে যায়। চকবাজার মৌলভীবাজারকে অনেক ভারী ভারী মোট টানতে হয়, তাই ওর সৌন্দর্য নেই। তুমি কোনো বন্ধুকে বলে দেখো না: চলো না ভাই, মৌলভীবাজার থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসি। দেখো সে কী বলে? একইভাবে যে জিনিসের ব্যবহার কম, প্রয়োজন কম, জীবনের কোনো কাজেই প্রায় আসে না, দেখবে তার মধ্যে তত বেশি সৌন্দর্য। এ জন্য রমনা পার্ক ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা।

তোমাদের এই স্কুলের মধ্যে দালান আছে, কোঠা আছে, অফিস আছে, ক্লাস আছে। কিন্তু এসব কিছুর চেয়ে সবার চেয়ে সুন্দর কী এই স্কুলের? ওই বিরাট দিগন্তছোঁয়া মাঠটা, তাই না? এই মাঠ দিয়ে কি কোনো কাজ হয়? মাত্র একটা জিনিসই হয়: আনন্দ। সেখানে খেলা হয়, প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া হয়। ওই অফুরন্ত সবুজের ভেতর নিজেকে প্রজাপতির মতো হারিয়ে ফেলা যায়। এই মাঠ দিয়ে জীবনের কোনো বাস্তব কাজ হয় না। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানদারি, লাভ-মুনাফা কিছুই না।

তাজমহলের কথা ধরো, তাজমহল দিয়ে কি কোনো কাজ হয়? এত বড় একটা স্মৃতিসৌধ। পৃথিবীর রমণীয়তম দালান। সেকালে ৯ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়েছিল। সে টাকা একালের হয়তো ৬০ হাজার কোটি টাকার সমান। অথচ দেখো, এত বড় আর অনিন্দ্যসুন্দর একটা দালান, ২১ হাজার লোক ২২ বছর পরিশ্রম করে যে দালান বানিয়েছে, সেই দালানে একটা রাত্রির জন্যও থাকার ব্যবস্থা নেই। কোনো কাজেই লাগে না সে। কাজে লাগে না বলেই ও এত সুন্দর। তুমি যাও না, গিয়ে বলো না, ‘বাবা, আমি একজন বাংলাদেশি মুসাফির, দেন না আমারে এখানে এক রাত থাকতে।’ দেবে থাকতে? ওই তাজমহলকে কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। করলে ও আর তাজমহল থাকবে না। ওর সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে। সে মৌলভীবাজার হয়ে যাবে। এত বড় একটা দালান, মাত্র এক দিনের জন্য ওখানে শ-দুই গরু রাখো না? ও কি তাজমহল থাকবে?

এই জীবনের যত জিনিস আছে, সবই আমাদের লাগবে। এতে একদিকে যেমন বাস্তব প্রয়োজন মিটবে, তেমনি সৌন্দর্যের বা উচ্চতর আনন্দের প্রয়োজনও মিটবে। দুয়ে মিলে আমরা পূর্ণ হব। আমাদের পাঠ্যপুস্তকও লাগবে, আবার আউট বইও লাগবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের সুন্দর সুন্দর বই লাগবে। কেন লাগবে? একটা বই মানে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আনন্দময়, যা কিছু আলোময় ছিল, সেসবেরই তো সমাহার। সুতরাং তাঁর কোনো বই যখন পড়ি তখন কতগুলো কাগজের পৃষ্ঠাই শুধু পড়ি না, রবীন্দ্রনাথের অন্তরের সমস্ত সৌন্দর্য আর আলোকেও আমরা স্পর্শ করি। অন্তরের মধ্যে একটা জ্যোতিপ্রবাহ তখন খেলা করে। আমি যদি শেক্‌সপিয়ার পড়ি, তবে তাঁর জ্যোতিও আমার মধ্যে আসবে। যদি প্লেটো পড়ি তবে তার জ্যোতিও আসবে। যদি অ্যারিস্টটল পড়ি, হাদিস পড়ি, কালিদাস পড়ি, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষদের শ্রেষ্ঠ ও সৌন্দর্যময় লেখা পড়ে যাই, তাহলে একদিন আমি কি এই আমি থাকব? থাকব না। আমি আমার চেয়ে অনেক সুন্দর, অনেক বিভাময়, বড় স্বপ্নে, বড় ভালোবাসায় আর মূল্যবোধ ভরা একজন মানুষ হয়ে যাব। (সংক্ষেপিত)

সূত্র: সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বক্তৃতা সংগ্রহ (দ্বিতীয় খণ্ড)