শুনতে কি পান এই নারীদের কান্না?

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

সৌদি আরবের এক সেফহোম থেকে ফোন করে এক নারী গড়গড় করে বলতে থাকেন, ‘আফা, অনেক কষ্টে আপনার নাম্বার পাইছি। আমরা অনেক কষ্টে আছি। আফা, আমাদের বাঁচান। কেউ কেউ পাগল হইয়া যাইতেছে। নিজের মাথা নিজেরা ফাটাইতাছে। একজন নিজের গলা নিজে কাইট্যা চোখের সামনেই মইরা গেল। তারপর থেইক্যা সবায় কয়, এইটা একটা ভূতের বাড়ি। আমরা যে কবে দ্যাশে যাইতে পারমু তা জানি না।’

৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শুধু এ নারী নয়, একাধিক নারী কথা বলেন টেলিফোনে। কান্নার দমকে অনেকের কথা অস্পষ্ট হয়ে যায়। তাঁদের একটাই আবেদন, দেশে ফিরতে চান।
একজন নির্যাতন প্রসঙ্গে বললেন, ‘শরীর খারাপের (মাসিক) সময়ও আমারে রেহাই দেয় নাই। বুইঝা লন কী কইছি আমি।’

এই নারীদের মুঠোফোনে করা ছোট একটি ভিডিও ক্লিপ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, এক নারী সেফহোমের ঘরটিতে ‘লাশ’ আছে ভয়ে আর কিছুতেই থাকবেন না বলে চিৎকার করছেন। ঘরটিতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন নারী ওই নারীকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

এই নারীরা একসময় নিজে ও পরিবারকে ভালো রাখার আশায় সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে যান। অনেককে গৃহকর্মীর কাজ না দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও আছে। অনেক নারীকে বাড়ির মালিক, ছেলে এবং অন্য পুরুষ সদস্যদের কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। খেতে না দেওয়া, কাজে একটু ভুল হলেই মারধর করা, বেতন না দেওয়া, এক বাড়ির কথা বলে কয়েক বাড়িতে কাজ করানো, বাড়ির জন্য মন কেমন করাসহ অন্যান্য সমস্যা ও নির্যাতনে অনেকে মালিকের বাড়ি থেকে পালিয়ে সেফহোমে আশ্রয় নিয়েছেন। মালিকপক্ষের মিথ্যা মামলাসহ নানান জটিলতায় এই নারীরা দেশে ফিরতে পারছেন না। কেউ অপেক্ষায় আছেন প্রায় এক বছর ধরে। অনেকে এ হোমে এসেছেন কয়েক মাস ধরে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে ১০০ জনের বেশি  নারী দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন। গত ২১ জানুয়ারি ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল ইসলাম অভিভাবকদের কাছ থেকে পাওয়া আবেদনের ভিত্তিতে লিখিতভাবে সৌদি আরবের রিয়াদের সেফহোম থেকে ২৪ নারী কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে ২৪ জনের তালিকাসহ চিঠি দেন। ২৪ জানুয়ারি বোর্ডের উপসচিব জহিরুল ইসলামের সই করা এক চিঠিতে এই ২৪ নারীকে দ্রুত দেশে ফেরত পাঠাতে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলরকে (শ্রম) চিঠি দেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই নারীরা এখন পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারেননি। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন এনজিওর কাছে এভাবে একের পর এক আবেদন জমা পড়ছে।

ব্র্যাকের ২৪ জনের তালিকা ধরে বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের টেলিফোনে যোগাযোগ করলে কারও বাবা, কারও স্বামী, ভাই কিংবা ছেলে আহাজারি করতে থাকেন। এখন আর কোনো টাকাপয়সার আশা নেই, শুধু পরিবারের সদস্যকে জীবিত ফেরত চান তাঁরা। এক ছেলে বললেন, ‘মায়ের চেহারা আর দেখমু কি না, বা দেখতে পাইলে কবে পামু তার কোনো গ্যারান্টি নাই।’

গত ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮ থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে ৩২৪ নারী গৃহশ্রমিক দেশে ফেরেন। তখন ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন ৭৫ জন নারী।

সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছর ১৮টি দেশে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল এক লাখের বেশি। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে যান ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশেরও বেশি নির্যাতনের শিকার হন। এখন নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ায় নির্যাতনের হারও বেড়েছে বলে ধারণা অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহ খাতে কর্মী নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। অবশ্য যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখেছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে লেবার কনফারেন্সের আয়োজন করে। এতে ২২টি দেশে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের দেখভালে নিয়োজিত ৪৪ জন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সৌদি আরবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সেখানে ফেরা পর্যন্ত এই নারীদের অপেক্ষা করতে হবে।

সম্মেলনের অংশ হিসেবে সংলাপের এক ফাঁকে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে কথা হলো সৌদি আরবের (রিয়াদ) শ্রম কাউন্সিলর সারওয়ার আলমের সঙ্গে। নারীদের নামে মালিকের মামলাসহ বিভিন্ন জটিলতার কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন, ‘দুই দেশের সরকার এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। জনবল সমস্যা তো আছেই।’

দেশে ফেরার পর

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের ২৫ বছর বয়সী এক নারী ও তাঁর স্বামী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর এই নারী সৌদি আরব গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসেছেন গত ১০ জানুয়ারি। এই সময়ের মধ্যে নির্মম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তিনি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে এই নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এই নারীর স্বামীর করা আবেদনেও নির্যাতনের কথা রয়েছে। এই নারী দেশে ফেরার পর মতিঝিল থানায় স্ট্যানফোর্ড এমপ্লয়মেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড নামের রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকসহ কয়েকজনের নামে করা মামলার এজাহারেও নির্যাতনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এই নারী প্রথম আলোকে জানান, সৌদি আরবে তাঁকে কয়েকটি বাসায় বিক্রি করা হয়। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করত একাধিকজন। তাদের কথা না শুনলেই যৌনাঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। বাথরুমে বন্দী থাকতে হয় অনেক দিন। মাথায় লোহার পাইপ দিয়ে মারা হতো। এই নারী বলেন, ‘মাথা খাড়া রাখতে পারি না। সারাক্ষণ মাথায় পানি ঢালি। প্রস্রাব করার পর শুধু জ্বালাযন্ত্রণা করে। কোনো কাজ করতে পারি না।’

এক বছরের কম বয়সী সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে বিদেশ গিয়েছিলেন এই নারী। বিদেশ যাওয়ার আগে ঋণ করেছেন অনেক টাকা। টেম্পোচালক স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে একবার যান হাসপাতালে, আবার যান থানা-পুলিশের কাছে। বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসছে মামলা তুলে নেওয়ার। আর যে দালালের মাধ্যমে এই নারী বিদেশ যান ওই দালাল লাপাত্তা।

এই নারীর স্বামী যৌন নির্যাতনের বিষয়টি শুরু থেকেই জানেন এবং তা মেনে নিয়েই স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু দেশে ফেরত আসা কয়েকজন নারী বললেন, তাঁরা সংসার টেকানোর জন্য যৌন নির্যাতনের কথা গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছেন।

৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক সংলাপে এক নারী বলেন, ‘বিদেশে কাজ করতে গিয়া খুব নির্যাতিত হইছি। দেশে আসার পরও একজন এক কথা কয় তো আরেকজন আরেক কথা। খারাপ বলে।’ এই নারীর প্রশ্ন ছিল, ‘বিদেশ গিয়েই নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসতে হলো, লাভটা কী হলো?’

অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সম্ভাবনা, সমস্যা এবং এই শ্রমিকদের ক্ষমতায়নের কৌশলবিষয়ক এই সংলাপে অভিবাসী নারী শ্রমিকদের দেখভালের আশ্বাস দিলেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম। তবে এটাও বলেন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে নারী গৃহকর্মীদের মালিকদের সঙ্গে বেশি দর-কষাকষি করতে গেলে হয়তো বলে দেবে তারা আর শ্রমিক নেবেই না। তাই কৌশলগতভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করতে হয়।

অবশ্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার অকপটেই স্বীকার করে নেন যে নারীদের বিদেশ যাওয়ার শুরুটা ভালোই ছিল। ধীরে ধীরে অবস্থার কিছুটা অবনতি হয়েছে এবং এই নারীদের অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সংলাপে সরকারি পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বললেন, বিদেশ গিয়ে অনেক নারীই ভালো আছেন। গণমাধ্যমে ওই নারীদের কথা কেউ বলে না। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের বক্তব্য, বিদেশে কাজ করতে গিয়ে যদি একজন নারীও নির্যাতনের শিকার হন, সে দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।