রাকিব স্বপ্ন দেখতে ভয় পান না

রাকিব উদ্দিন। ছবি: খালেদ সরকার
রাকিব উদ্দিন। ছবি: খালেদ সরকার

বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানে কাজ করতেন রাকিব উদ্দিন। ব্র্যাক ব্যাংক–প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে তিনি উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পেরিয়েছেন। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালীতে সেরা ফলাফলের জন্য পেয়েছেন প্রিন্সিপাল অ্যাওয়ার্ড। পড়ুন এক হার না মানা তরুণের গল্প

স্কুলে পড়ার সময় হাতিয়ার চরকৈলাশ গ্রামের রাকিব উদ্দিন কখনো ঢাকায় আসার কথা ভাবেনওনি। কলেজে পড়ার স্বপ্ন তাঁর কাছে ‘আকাশকুসুম’ মনে হতো। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে যখন রাকিবের সঙ্গে কথা বলছি, তখন তাঁর হাতে দুটো ক্রেস্ট। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী থেকে স্নাতক (বিএসসি) পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি প্রিন্সিপাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ‘ট্যালেন্ট কমপিটিশন অব টেক্সটাইল-২০১৬’ শিরোনামের একটি আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। ক্রেস্ট দুটো হাতে রেখে নিজের গল্প বলতে বলতে রাকিবের চোখ ছলছল করে। চলুন, এক অদম্য মেধাবীর কথা শোনা যাক।

নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে চরকৈলাশ গ্রাম। সে গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। অন্ধকার নামত সন্ধ্যার আগেই। চা-বিক্রেতা বাবা আলতাফ হোসেন যেখানে বাড়ির সাত সদস্যের মুখে খাবার তুলে দিতেই হিমশিম খান, সেখানে রাতে কেরোসিন খরচ করে পড়ালেখা করা রীতিমতো ‘বিলাসিতা’। রাকিবকে তাই সকালেই স্কুলের পড়া শেষ করতে হতো। তার ওপর বাবাকে সাহায্য করতে হতো চায়ের দোকানে।

ঘুম থেকে উঠে দোকান খুলে চায়ের চুলা জ্বালানো ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ। পাশাপাশি বর্গাজমিতে কাজে জোগান দিতে হতো তাঁকে। কিন্তু পড়াশোনায় আগ্রহ যাঁর, তাঁকে তো দমিয়ে রাখা যায় না। কোনোমতে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পঞ্চম শ্রেণিতে ক্লাসে রোল হলো ১। অভাবের কারণে তত দিনে বড় ও মেজ বোনের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান রাকিব। বৃত্তির টাকার ওপর ভরসা করে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে।

‘বাবার চায়ের দোকানে চা বানানোর ফাঁকে ফাঁকে পড়তাম। এসএসসি পরীক্ষার আগে দোকানে বসেই টেস্ট পেপার সমাধান করতাম। চাচাকে বলে কেরোসিনের ব্যবস্থা করেছিলাম, যেন রাতের বেলায় পড়তে পারি।’ বলছিলেন রাকিব। তাঁর সংগ্রাম বৃথা যায়নি। ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল, সুখচর ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু উচ্চবিদ্যালয় থেকে যে দুজন গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের মধ্যে একজনের নাম রাকিব উদ্দিন। কিন্তু এই আনন্দ তাঁকে স্পর্শ করেনি। কারণ তখনো জানতেন না, কলেজে ভর্তি হতে পারবেন কি না। টাকার অভাব তো আছেই, তার ওপর কলেজে ভর্তি হলে চায়ের দোকানের কাজে সহায়তা করতে পারবেন কি না, এই নিয়েও শঙ্কা ছিল বাবার মনে।

রাকিবের সংগ্রামের কথা গ্রামের সবাই জানত। কলেজে পড়া হবে কি হবে না, এই দোটানার মধ্যে একদিন তাদের বাড়িতে হাজির হন প্রথম আলোর হাতিয়া প্রতিনিধি ও মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁরা ঢাকার ভালো কোনো কলেজে ফরম পূরণের জন্য তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন। এরই মধ্যে অদম্য মেধাবী রাকিবের খবর ছাপা হয় প্রথম আলোয়। যাচাই-বাছাইয়ের পর তিনি ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হন। পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটে। রাকিব ভর্তি হন ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজে।

২০১২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও জিপিএ-৫ পেয়ে সাফল্য ধরে রাখেন। ‘এত ভালো ফল করেও খুশি হতে পারিনি। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেব, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। প্রথম আলোয় আমার উৎকণ্ঠার খবর ছাপা হয় “প্রতিশ্রুতি পূরণে আরেক ধাপ এগিয়ে” শিরোনামে। উচ্চমাধ্যমিকের পরও আমার শিক্ষাবৃত্তি চালু রাখে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট। আবারও সাহস ফিরে পাই।’ বলছিলেন রাকিব।

কিন্তু ভর্তিযুদ্ধ তো তখনো বাকি। এখানেও সফলতা অব্যাহত থাকে। কোনো কোচিংয়ে ভর্তি না হয়েও রাকিব সুযোগ পেয়ে যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলসের অধিভূক্ত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালীর ‘ওয়েট প্রসেস ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগে। প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তির সহায়তায় চলতে থাকে পড়াশোনা।

এর মধ্যে বাবা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। ফলে চায়ের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। নতুনভাবে বিপদের মধ্যে পড়ে পরিবারটি। এত বাধা-বিপত্তির পরও নিজ বিভাগে প্রতি সেমিস্টারের প্রথম স্থান থাকে রাকিবের দখলে। প্রথম স্থান ধরে রেখেই স্নাতক শেষ করেছেন তিনি। আমাদের আলাপে চায়ে চুমুক দিতে দিতে রাকিব বলছিলেন, ‘প্রথম আলো আমার স্বপ্নকে বাঁচিয়েছে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই।’

অসুস্থ মা হাছিনা বেগম ছেলের সাফল্যে ভীষণ খুশি, কৃতজ্ঞতা জানালেন প্রথম আলোর প্রতি। ছেলে একটা ভালো চাকরি করবে, পরিবারের হাল ধরবে, এখন এটাই তাঁর প্রত্যাশা। আর মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করা এখন রাকিব উদ্দিনের লক্ষ্য। গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতকে আরও উন্নত করতে চান তিনি। জীবনে ভালো কিছু করতে হলে যে লড়াই করতে হয়, সেটা তিনি জানেন। তাই সাহসী রাকিবের কাছে এখন বোধ হয় আর কোনো কল্পনাই ‘আকাশকুসুম’ মনে হয় না!

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী কার্যক্রমের আওতায় প্রতি বছর উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে তাঁদের নির্বাচন করেন। এখন পর্যন্ত এই তহবিলের আওতায় ৭৫০ জন শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বর্তমানে বৃত্তি পাচ্ছেন ৩১৬ জন। এ কার্যক্রমে সহায়তা করছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, ট্রান্সকমসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে এই অদম্য মেধাবীদের পাশে দাঁড়ান।