পাত্রীর মন হতে হবে 'ফুলের মতো নরম'

>

প্রথম আলোর নারীমঞ্চে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী, শিক্ষিত, সংসারী পাত্রী চাই!’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনের ভাষায় এখন কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? এটা বোঝার জন্য বিভিন্ন পত্রিকার বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা, ঘটকালি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নারীমঞ্চের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। দুই বছরে কিছুটা পরিবর্তন এলেও পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের ভাষায়, অর্থাৎ বিয়ের পাত্রী হিসেবে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি।

‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের ভাষায় বিয়ের পাত্রীকে প্রথমত সুন্দরী হতে হবে। এর সঙ্গে শিক্ষিতা, মেধাবী, সাংসারিক, ধার্মিক, সম্ভ্রান্ত পরিবারের নম্র স্বভাব, সরলমনা, এমনকি পাত্রীর মন যাতে ‘ফুলের মতো নরম’ হয় সেই আবদারও করা হচ্ছে।

ঢাকার অভিজাত এলাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাট, কয়েকটি প্লট, গাড়ি, একাধিক কোম্পানির মালিক, ইংরেজিতে মাস্টার্স পাত্রের জন্য দরিদ্র পরিবারের হলেও চলবে, কিন্তু ‘সুন্দরী’ পাত্রী লাগবে বলে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

পাত্রীর পরিবারও পাত্র চাই বিজ্ঞাপনে মেয়ে ‘অনিন্দ্য সুন্দরী’ ‘অসাধারণ সুন্দরী’, বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, মেয়ের কোনো ভাই নেই, মেয়ের নামে বাড়ি আছে, পাত্রকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া, ব্যবসার কাজে সহায়তা করা হবে ইত্যাদি যোগ্যতা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। একটি বিজ্ঞাপনে পাত্রী ‘এ গ্রেড’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

পত্রিকা ঘেঁটে দেখা গেল, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিয়ের পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে কিছু নতুন বিষয় যোগ হচ্ছে। ছেলে বা মেয়ে তালাকপ্রাপ্ত হতে পারবে, সন্তানসহ বিয়ে করতে আপত্তি নেই, আবার সন্তান না হলেও সমস্যা নেই, মেয়ের বয়স তিরিশের বেশি হলেও আপত্তি নেই—এ ধরনের কথাও যোগ হচ্ছে বিজ্ঞাপনে। বর্তমানে শুধু মেয়ের পরিবার নয়, মেয়ে নিজেও অনেক ক্ষেত্রে কেমন ছেলে পছন্দ তা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। কেউ কেউ পাত্রীর বেলায় শুধু ‘যোগ্য পাত্রী’ চাই বলেও উল্লেখ করছেন। পাত্র বা পাত্রী কোন জেলার হলে ভালো হয়, তা-ও বিজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকছে।

এখন কেমন পাত্র-পাত্রী পছন্দ তার একটা ধারা বোঝা যায় ঘটকালি প্রতিষ্ঠান বা ম্যারেজ সেন্টারের তথ্য থেকে। ঢাকার সোনিয়া আপা হোম সার্ভিসের মালিক সোনিয়া বেগম জানালেন, বিয়ের পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। ১২ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন তিনি। সোনিয়া বলেন, ‘আগে যেমন একচেটিয়াভাবে শুধু “সুন্দরী” পাত্রীর চাহিদা ছিল, এখন পাত্রীর অন্যান্য যোগ্যতাও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। পাত্রের বয়স ৩০ হলে পাত্রীর বয়স ২৮ হলেও সমস্যা থাকছে না। কেননা, পড়াশোনা শেষ করে একজন মেয়ের চাকরিতে ঢুকতে ঢুকতে বয়সটা তো আর থেমে থাকে না।’

পাত্রীর যোগ্যতার লম্বা ফর্দ

পাত্রীকে হতে হবে সব দিক থেকে সেরা। তাই যোগ্য পাত্রী হতে হলে ফর্দটা বেশ লম্বাই হয়। তবে পাত্রী চিকিৎসক, প্রকৌশলী যা-ই হোন না কেন, প্রথমত তাঁকে ‘সুন্দরী’ হতে হবে এই ধারণার খুব একটা বদল ঘটেনি। এরপর লম্বা চুল, ফরসা ত্বক, উচ্চতা, বয়স, মেধা, শিল্পপতির মেয়ে ইত্যাদি চাওয়া হচ্ছে পাত্র মানে ছেলের পক্ষ থেকে।

মেয়ে ফরসা না হলে, বয়স বেশি হলে, তালাকপ্রাপ্তা হলে, আগের ঘরের সন্তান থাকলে মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনের ভাষায় অসহায়ত্বের মাত্রাটা বাড়তে থাকে। একটি বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে—‘উজ্জ্বল শ্যামলা, সুশ্রী পাত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট আছে।’ অর্থাৎ পাত্রী সুন্দরী না হলেও অন্যভাবে পুষিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।

পাত্রের বয়স বেশি হলেও খুব একটা সমস্যা নেই তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরেকটি বিজ্ঞাপনে। সেটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘৪১ বছর বয়সী পাত্রের জন্য পাত্রীর বয়স সর্বোচ্চ ২৭ বছর হতে হবে।’ কানাডাপ্রবাসী তালাকপ্রাপ্ত একজন পাত্র বিজ্ঞাপনে তাঁর চাহিদার কথা জানিয়েছেন এভাবে—‘ইন্টেলিজেন্ট, কেয়ারিং, অনেস্ট, কেয়ারটেকার, ইনোসেন্ট হার্ট, লাভিং, রোমান্টিক... পাত্রী চাই।’

১৮ থেকে ২১ বছরের পাত্রী চেয়ে এক বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে, ‘পাত্রীকে সুন্দরী, লম্বা চুল এবং সাংসারিক হতে হবে।’ একজন পাত্র নিজের গায়ের রং শ্যামলা উল্লেখ করে ‘সুন্দরী, ভালো চরিত্রের’ পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।

অন্যদিকে সুন্দরী, স্নাতকোত্তর, তালাকপ্রাপ্ত পাত্রীর জন্য যে পাত্র চাওয়া হয়েছে, তাকে শুধু ‘শিক্ষিত’ হলেই চলবে। কানাডার ‘সিটিজেনশিপ’ পাওয়া এক সন্তানসহ ‘বিধবা’ ‘সুন্দরী’ ‘গ্র্যাজুয়েট’ পাত্রীর পরিবার পাত্রের যে যোগ্যতা চেয়েছে, তা হলো পাত্রকে শুধু কানাডায় যেতে ইচ্ছুক হতে হবে। আরেকটি বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, পাত্রীর ঢাকায় বাড়ি, গাড়ি আছে, বিয়ের পর পাত্রকে কানাডায় নিয়ে যাওয়া হবে—এ ক্ষেত্রে শুধুই ‘উপযুক্ত’ পাত্র চাওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিয়ে-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনকে গবেষণার আওতায় আনা হয়েছে। বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন একটি সমাজে নর-নারীর ভূমিকা নির্দেশক। সেদিক থেকে দেখলে বৈবাহিক বিজ্ঞাপনে বড় কোনো পরিবর্তন না দেখাটাই স্বাভাবিক। কেননা, প্রধানত সমাজ-মানসের যে প্রকাশ আমরা শ্রেণিবদ্ধ (ক্লাসিফায়েড) বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই, সেখানে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো নারীর জন্য তার দৈহিক সৌন্দর্য, ঘরোয়া মনোভাব এবং পুরুষের জন্য অর্থ-বিত্ত-প্রতিষ্ঠাই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বিশ্বায়ন প্রবাসী পাত্র-পাত্রীর গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে যে জনমিতিক পরিবর্তনটি বিজ্ঞাপনেও প্রতিবিম্বিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়া। আগের চেয়ে নারীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার কিছুটা প্রভাব হয়তো বৈবাহিক বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, তার এককভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

গীতি আরা নাসরীন মনে করেন, শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনগুলো এখনো অসচেতন বা ছাঁচে ঢালা চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। তবে পৃথিবীতে এখন ডিসপ্লে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিয়ের সম্পর্কে যেসব পরিবর্তন প্রকাশের চেষ্টা দেখতে পাই, বাংলাদেশে তা চোখে পড়ে না।

যতটুকু পরিবর্তন

‘প্রতিকার’ নামের একটি ম্যারেজ সেন্টার এক বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, দাম্পত্য বিচ্ছেদ? এটিও নারীর অধিকার। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ও পুনর্বাসনে আমরা পাশে আছি। এই প্রতিষ্ঠান পাত্রীকে পুনরায় পাত্রস্থ করার আশ্বাসও দেয়।

একজন বিজ্ঞাপনে জানিয়েছেন, জাপানে পিএইচডি করতে ইচ্ছুক পাত্রী খুঁজছেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ুয়া পাত্রী নিজেই লিখেছেন, ‘আমি খুব সুন্দরী নই, তবে দেখতে খারাপ নই।’ আরেক পাত্রী ‘প্রতিষ্ঠিত, সুন্দর, গ্র্যাজুয়েট, ভালো পরিবার, ভালো জব...’ এসব গুণের পাত্র চেয়েছেন। আরেকজন ‘ফ্রেশ মাইন্ডের স্মার্ট’ পাত্র চেয়েছেন। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী পাত্রী চেয়েও অনেকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন।

অনলাইনভিত্তিক ঘটকালি প্রতিষ্ঠান বিবাহ বিডি ডটকমের কল সেন্টারে ফোন করলে ধারণ করা বক্তব্য শোনা যায়—‘জীবন একটাই। আর সুখী জীবনের জন্য চাই সুন্দর মনের মানুষ।’ এখানে পাত্র-পাত্রী না বলে ‘উপযুক্ত জীবনসঙ্গী’ বলা হচ্ছে।

বিবাহ বিডি ডটকমের নির্বাহী প্রধান জি এম ফ্রেজার প্রথম আলোকে বলেন, বিয়ের সময় মেয়ের কম বয়স বা সৌন্দর্য চাওয়ার বিষয়টি খুব সহজে পরিবর্তন হবে না। তবে ছেলেমেয়ে ‘তালাকপ্রাপ্ত’ হলে আপত্তি নেই—এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্যতা এসেছে। অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে নিজেদের তালাকপ্রাপ্ত, বিপত্নীক বা বিধবা বাবা-মায়ের বিয়ের জন্য এখানে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। বিবাহ বিডি ডটকমে যেসব নারী নিবন্ধন করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত এবং চাকরিজীবী। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে পারছেন।