আলোকচিত্রে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া নিজের ছবির পাশে রত্না।  ছবি: খালেদ সরকার
প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া নিজের ছবির পাশে রত্না। ছবি: খালেদ সরকার

রত্নার গল্পের সূত্রপাত ২০০২ সালে। বিয়ের দিনই সোনা, আসবাব, বাইসাইকেল আর ২০ হাজার টাকা নগদ অর্থ বরপক্ষকে যৌতুক হিসেবে দেন তাঁর গরিব মা-বাবা। একটা ছোট সুন্দর সংসারের বাইরে রত্নার তেমন কোনো চাওয়া ছিল না।

বিয়ের কিছুদিন পার হতেই শুরু হয় বিপত্তি। আরও নগদ অর্থ বাবার বাড়ি থেকে আনতে চাপ দিতে শুরু করেন স্বামী মিলন। যৌতুকের চাপ বাড়তেই থাকে। একসময় রত্নার ওপর শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। রত্না যখন চার মাসের গর্ভবতী, তাঁকে যৌতুকের জন্য বাড়ির বাইরে দড়ি দিয়ে বেঁধে লাঠিপেটা করতে থাকেন তাঁর স্বামী। শ্বশুরবাড়ির কেউই তাঁকে বাঁচাতে আসেননি। তাঁর চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। রক্তাক্ত রত্না চেতনা হারিয়ে ফেলেন। প্রতিবেশীরা তাঁকে দিয়ে আসেন তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয় হাসপাতালে।

রাজশাহীর আঞ্জু আরা আক্তার রত্নার গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু তাঁর বদলে যাওয়ার গল্পের শুরু এখান থেকেই। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সহায়তায় এক মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন রত্না। মহনপুর থানায় মামলা দায়ের করেন তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে। পুলিশ মিলন ও তাঁর পরিবারকে গ্রেপ্তার করে। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর রত্না জানতেন না তাঁর ভাগ্যে কী রয়েছে। এমন সময় ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিসের সভা থেকে ডাক আসে রত্নার। সেখানে যেতেই তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পোশাক তৈরির কাজ জানা রত্না স্বল্প পুঁজি সহায়তা পেতেই বুটিকের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বর্তমানে নিজের বিউটি পারলার ও বুটিক হাউস একসঙ্গেই চালাচ্ছেন তিনি। স্বাবলম্বী রত্না তাঁর স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে বেশ সুখে আছেন।

রত্নার গল্পটা জানা গেল কীভাবে? তাঁর মতো আরও নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনের গল্পের খোঁজ পাওয়া গেল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে। ২০ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয় ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (ড্যানিডা) উদ্যোগে আয়োজিত আলোকচিত্রী জি এম বি আকাশের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ক্ষমতায়নের মুখগুলো’র। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মিকেইল হেমনিতি উইন্থার। সঙ্গে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন রত্না।

রত্নার ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে আত্মশক্তি হিসেবে কী কাজ করছিল? ‘নিজের ছেলেকে মানুষ করতে হবে সেটাই মাথায় কাজ করছিল। আর তার চেয়েও বড় কথা, আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখলে আরও অনেক নির্যাতিত নারী উৎসাহ পাবে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে।’ পুরো অনুষ্ঠানে তাঁর হাসিমুখই বলে দিচ্ছিল ছেলেকে নিয়ে কতটা সুখে আছেন তিনি।

শুধু রত্নাই নন। বরিশালের শিল্পী আক্তারের গল্পের শুরুটাও সুখের ছিল না। মাদকাসক্ত স্বামী সংসারে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতেন না। ছয় সন্তানকে নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে একরকম দিন পার করছিলেন তিনি। এর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি হারান। আশ্রয় নেন এক আত্মীয়ের বারান্দায়। একদিন খোঁজ পান তাঁর এলাকার রাস্তা উন্নয়নের কাজের জন্য লোক নেওয়া হবে। ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপশন প্রজেক্ট থেকে দেওয়া হবে প্রশিক্ষণও। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহযোগিতা পাওয়ার মাধ্যমে নিজের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করতে সক্ষম হন শিল্পী আক্তার। জি এম বি আকাশ ফ্রেমবন্দী করেছেন বঞ্চিত এমন অনেক নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পগুলোকে।

আলোকচিত্রগুলো ঘুরে দেখলেই বোঝা যায়, নারীরা এখন আর পিছিয়ে থাকতে চান না। একটু সহযোগিতা পেলে তাঁরাও যে উন্নয়নে অংশীদার হতে পারেন, সেটা প্রমাণ করতে চান। নারীর ক্ষমতায়নে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের পাশে তাই ডেনমার্ক সহযোগিতা বজায় রাখতে চায়। বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মিকেইল হেমনিতি উইন্থার বলেন, ‘ডেনমার্ক নানা রকম কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অবস্থার উন্নয়নে সাহায্য করছে। নারীদের উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে।’ ভাগ্য পরিবর্তনের এই গল্পগুলোর প্রদর্শনী চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত।