আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভালোবাসা

>১৯৭৬ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন উত্তর আয়ারল্যান্ডের সমাজকর্মী ম্যারেইড ম্যাগুয়ার। পিস পিপল নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে তিনি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের কথা শুনেছেন। মানুষগুলোর দুঃখ তাঁকে কাঁদিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার চেয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে নোবেল কর্তৃপক্ষকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ম্যারেইড ম্যাগুয়ার। সেই সাক্ষাৎকার থেকে সংগৃহীত কিছু কথামালা আজ ছাপা হলো।
ম্যারেইড ম্যাগুয়ার। ছবি: খালেদ সরকার
ম্যারেইড ম্যাগুয়ার। ছবি: খালেদ সরকার

১৯৭৬ সালের ১০ আগস্ট। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিল আমার ছোট বোন অ্যানি। এমন সময় আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) আর ব্রিটিশ আর্মির মধ্যে একটা সংঘর্ষ শুরু হলো। আইআরএর একজন গাড়িচালকের দিকে গুলি ছুড়ল ব্রিটিশ আর্মি। গুলিবিদ্ধ গাড়িচালক গাড়িসমেত সোজা ছুটে গিয়েছিলেন ফুটপাথের দিকে। আঘাত করেছিল আমার ছোট বোন আর তার তিন ছেলেমেয়েকে। বাচ্চারা কেউ বাঁচেনি। আট বছর বয়সী জোয়ানা, আড়াই বছরের জন। অ্যানড্রিউর বয়স ছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ। আইআরএর গাড়িচালক ড্যানি লেননও মারা গিয়েছিলেন। গুরুতর আহত হয়েছিল আমার বোন অ্যানি। তখনই আমরা কয়েকজন এক জোট হয়েছিলাম। দৃঢ় গলায় বলেছিলাম, ‘আর না। এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সহিংসতা কোনো সমাধান নয়।’ অতএব আমি, বেটি উইলিয়ামস ও তরুণ সাংবাদিক সিয়ারান ম্যাককেওন মিলে কাজ করতে শুরু করলাম। সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আমরা নানা রকম কার্যক্রম শুরু করলাম। এভাবেই ‘পিস পিপল’ এর শুরু।

নোবেল পুরস্কার পেয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। কারণ আমার ভয় হচ্ছিল। ভাবছিলাম, আমি তো জানি না, এত বড় একটা সম্মানের প্রতি কীভাবে সুবিচার করব। আমি খুব সাধারণ একজন নারী। এটা ঠিক আমি সমাজের জন্য কাজ করেছি। কিন্তু রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কখনোই সেভাবে যুক্ত ছিলাম না। হঠাৎ করেই আমার কাছে বড় বড় সাংবাদিকেরা আসতে শুরু করলেন, তাঁরা কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করতে লাগলেন। যেমন পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য আমি কী ভূমিকা রাখব। শুনে অবাক হলাম। ভাবলাম, এরা কী বলছে! পৃথিবী সম্পর্কে আমি কতটুকুই বা জানি! একই সঙ্গে অভিভূত এবং বিপন্ন বোধ করছিলাম। অতএব নোবেল পাওয়ার পর প্রথম কয়েক বছর আমি পুরস্কারের পাশাপাশি ভয়টাও বহন করেছি। বিভিন্ন দেশে গিয়েছি, কথা বলেছি। তখন নিরাপত্তা নিয়েও আমার ভেতর খানিকটা শঙ্কা কাজ করত। ধীরে ধীরে এই ভয় কাটিয়ে উঠে আমি ব্যাপারটা মেনে নিয়েছি এবং উপভোগ করতে শুরু করেছি। নোবেল পুরস্কারের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। সব সময় চেষ্টা করি, এই পুরস্কার কাজে লাগিয়ে আমি যেন মানুষকে সাহায্য করতে পারি।

আমার কাছে শান্তি মানে হলো মনের ভেতর একটা আনন্দ অনুভব করা। নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। নিশ্চয়ই আপনার জীবনে দুঃখ আসবে, যেমনটা সবার জীবনে আসে। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যার জীবনে কোনো সমস্যা নেই, যে জীবনে কখনো কষ্ট পায়নি। কিন্তু এই দুঃখকষ্টের পরও আমাদের জীবনটা সুন্দর। সুন্দর জীবনটা আরও সুন্দর হবে, যদি আপনি আপনার আশপাশের মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্কটা আরও গভীর করেন। পরিবারের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে, সমাজের মানুষগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক আপনাকে ভালো রাখবে।

পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা নানা রকম প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আমরা চেয়েছিলাম, এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীটাকে বদলে দেব। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে বাস্তবতাটা বুঝলাম। বুঝলাম, এসব প্রকল্পের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ, আর মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। আশপাশের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে তবেই না আপনি জীবনে সুখের সন্ধান পাবেন।

আজকের দিনে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, আমরা এখনো বিশ্বাস করি সামরিক শক্তি আর সহিংসতা সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমরা মনে করি অস্ত্র ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করা যায়। অথচ এগুলোই সমস্যা তৈরি করে। বিশ্বের অনেক দেশই মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে সামরিক শক্তি ব্যবহার করছে। আমরা পৃথিবীর মানুষেরা সবাই একটা পরিবারের মতো। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের চমৎকার কিছু আইন আছে, মানবাধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট নীতিমালা আছে। এসবের তোয়াক্কা না করে আমরা পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। একটা মানুষকে আরেকটা মানুষ হত্যা করার তরিকা শেখানো হচ্ছে, এটা খুব নিষ্ঠুর একটা প্রক্রিয়া। অথচ এটা সব দেশে হচ্ছে, সব সরকারই করছে। সামরিক শক্তি নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকারের ধারণাই আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সব মানুষের অধিকার সমান। এখানে শক্তিশালী কিংবা দুর্বল বলে কিছু নেই।

আমার সৌভাগ্য, আমি অসাধারণ মা-বাবা পেয়েছি। তাঁদের আদর্শ আমাকে পথ দেখিয়েছে। আরও একজনের কথা বলতেই হয়। তিনি ডরোথি ডে। তরুণ বয়সে তাঁর জীবনযাত্রা আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল। ডরোথি যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা, আমার চেয়ে অনেক দূরে তাঁর বসবাস। তিনি যুদ্ধ এবং সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করতেন। তিনি গরিব মানুষের জন্য ঘর তৈরি করে দিতেন, তাঁদের সঙ্গে থাকতেন। আমি সব সময় তাঁর কর্মকাণ্ডের খোঁজ রাখতাম আর ভাবতাম, কী অসাধারণ একজন মানুষ! আমার সৌভাগ্য, নোবেল পাওয়ার পর আমি নোবেলের মেডেলটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম। বন্ধুরা বলেছিল, এত দূর এটা বহন করা নিরাপদ নয়। মেডেলটা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে, হারিয়ে যেতে পারে। আমি ওদের কথা শুনিনি। কারণ ডরোথিই তো আমার অনুপ্রেরণা। আমি শুধু পুরস্কারটা তাঁকে দেখাতে চেয়েছি। তিনি দরিদ্রের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলতেন, সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতেন। আমেরিকা যদি সেই সময় তাঁর কথা শুনত, তাহলে হয়তো আমাদের এত যুদ্ধ, এত দারিদ্র্য দেখতে হতো না।

যখন ছোট ছিলাম, প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম, সিস্টার লুইস নামে একজন আমাদের পড়াতেন। আমি লিখতে ভালোবাসতাম। সিস্টার লুইস আমার লেখাগুলো বাসায় নিয়ে যেতেন। সব সময় আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন। বলতেন, ‘তুমি পারবে।’ তিনি আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছিলেন। তাঁর কাছেই আমি জেনেছি, সৃষ্টিকর্তা সবার মধ্যেই কোনো না-কোনো বিশেষত্ব দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আমার মধ্যেও কোনো না-কোনো বিশেষত্ব আছে। এই বিশেষত্বটাকে প্রস্ফুটিত করা, এটাকে কাজে লাগানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি আপনার বিশেষত্বটা খুঁজে বের করতে পারেন, তবেই এটা উপভোগ করবেন। জীবনটাকে ভালোবাসবেন। এই বিশেষত্ব কাজে লাগিয়ে আপনি আপনার আশপাশের মানুষগুলোর জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবেন। সমাজে পরিবর্তন আনতে পারবেন।

তরুণদের উদ্দেশে আমি বলব, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। মনে রেখো, আমরা সবাই বিশেষ গুণের অধিকারী। অন্যকে ভালোবাসার জন্য, আর ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই আমাদের জন্ম। তাই নিজেকে ও অন্যকে ভালোবাসার চর্চা করো। জীবনে যা পেয়েছ, তার জন্য কৃতজ্ঞ হও। তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে সাহায্য করো। আজকের দিনে ভালোবাসাই আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ভালোবাসাই মানুষকে সুখী করে। তোমার মনে যদি সুখ না থাকে, নিজেকে জিগ্যেস করো, কেন তুমি সুখী নও। বেরিয়ে পড়ো, পৃথিবীটা দেখো, গান শোনো, চিত্রকর্ম দেখ। কত সুন্দর সুন্দর দেশ আছে পৃথিবীতে! আমি মনে করি এসব আমাদের জীবনের সৌন্দর্য, জীবনের রহস্যময়তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। সব সমস্যা নিয়ে তুমি ভেবো না। সমস্যা সমাধান করা তোমার একার কাজ নয়, এর জন্য প্রয়োজন দলীয় প্রচেষ্টা। এই দায়িত্ব আমাদের সবার। জীবনটাকে উপভোগ করো। তোমার যা কিছু গুণ আছে, তার সবটুকু দিয়ে পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করো।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ
সূত্র: নোবেলপ্রাইজ ডট ওআরজি