অদম্য পর্বতারোহী

মেঘের ফাঁকে ওই দূরে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। ছবি: লেখক
মেঘের ফাঁকে ওই দূরে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। ছবি: লেখক

কিছুদিন আগের কথা। ফেসবুক মেসেঞ্জারে হঠাৎই পেয়ে গেলাম বিখ্যাত পর্বতারোহী কিম হং বিনকে। মিনিট পাঁচেক কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে তিনি পৃথিবীর দশম উচ্চতম পর্বত অন্নপূর্ণা-১ অভিযানে যাবেন। আমিও আমার সামনের দিনগুলোর পরিকল্পনার কথা জানালাম। পৃথিবীতে এভারেস্টের সমকক্ষ উচ্চতার (৮ হাজার মিটার) পর্বতশৃঙ্গ আছে ১৪টি। পৃথিবীর সেরা পর্বতারোহীরা সবাই এই ১৪টি পর্বত জয়ের স্বপ্ন দেখেন। যদিও স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিম হং বিন এরই মধ্যে ১১টি ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গে পা রেখেছেন। যে ১৪টি পর্বতের কথা বলছি, তার মধ্যে অন্নপূর্ণা ১ সবচেয়ে বিপজ্জনক। একটি পরিসংখ্যান বললেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেখানে এভারেস্টে মৃত্যুর হার মাত্র ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে অন্নপূর্ণা ১-এ মৃত্যুর হার ৩৮ শতাংশ! কিম হং বিন এবার সেই খুনে পর্বত জয় করতে যাচ্ছেন। মানুষটির দুই হাতের দশ আঙুল নেই, অথচ তিনি অসম্ভব মানসিক শক্তির অধিকারী। দক্ষিণ কোরিয়ার এই পর্বতারোহীর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৩ সালে। আমি সেবার কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে বেরিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া অধরা থেকে গেছে, কিন্তু অভিযানের সুযোগে কিমের সঙ্গে পরিচয় হওয়া নিশ্চয়ই একটা বড় পাওয়া। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানেই আরও একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, হাঙ্গেরির বিখ্যাত পর্বতারোহী জোত ইরোস। অতিরিক্ত বোতলজাত অক্সিজেন ছাড়া নয়টি ৮ হাজার মিটার পর্বত আরোহণ করেছেন তিনি। তাঁর প্রসঙ্গে পরে আসছি।

কিম হং বিনের সঙ্গে লেখক
কিম হং বিনের সঙ্গে লেখক

কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত। ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট উঁচু। নেপাল ও ভারতের সিকিম রাজ্যের সীমান্তের এই পর্বতশৃঙ্গ বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থানার বাংলাবান্ধার উত্তরের একেবারে শেষ বিন্দু থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে আমাদের দেশের উত্তরের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলা থেকে পর্বতশৃঙ্গটি দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের জন্য এমনকি ভারতীয়দেরও যেতে হয় নেপাল দিয়ে। খ্যাতি আছে খুনে পর্বত হিসেবেও। মৃত্যুর হার ২১ দশমিক ৪ শতাংশ। এমন বিপজ্জনক পর্বতে অভিযানের পরিকল্পনা আঁটছিলাম বহুদিন ধরেই। হিমালয়ে প্রতিবছর সাধারণত প্রি-মনসুন (এপ্রিল-মে) ও পোস্ট মনসুন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর)—এই দুই মৌসুমে পর্বতারোহণ করা হয়। ২০১২ সালে এভারেস্ট জয়ের পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে ২০১৩ সালের প্রি-মনসুন মৌসুমে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে যাব।
ছয় দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্পে (১৮ হাজার ২০০ ফুট) পৌঁছাই। পর্বতে স্বল্প অক্সিজেনে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য বেসক্যাম্প থেকে অগ্রবর্তী ক্যাম্পগুলোতে বেশ কয়েকবার ওঠানামা করতে হয়। এই মানিয়ে নেওয়ার কাজটি করার জন্যই অভিযানের মূল সময়টা কেটে যায়। এক নম্বর ক্যাম্পে এক রাত এবং দুই নম্বর ক্যাম্পে এক রাত থেকে পরদিন আবার বেসক্যাম্পে নেমে আসি। পরের তিনটি দিন বেসক্যাম্পে অলসভাবেই কেটে গেল। এ সময় আসলে তেমন কিছু করার থাকে না। কত ভাবনা এসে মনে উদয় হয়। পরিবারের সবাই এখন কী করছে, কিংবা ক্লাবের বন্ধুরা। মানুষের কোলাহল থেকে বহু দূরে হিম বরফের এই বিপদ অরণ্যে আমি একা। নিজেকেই নিজে প্রেরণা দিই। অবশ্য বড় প্রেরণা তো চোখের নাগালেই আছে। ওই যে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর! মেঘ ফুঁড়ে তার দিকে চোখ পড়লেই শিহরণ খেলে যায়।

অনুপ্রেরণা দিয়েছেন জোত ইরোস
অনুপ্রেরণা দিয়েছেন জোত ইরোস


আমি যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর দেখে প্রেরণা খুঁজছি, এরই মধ্যে আমার সামনে একদিন আরও এক প্রেরণা হাজির। তিনি কিম হং বিন। ১৯৯১ সালে উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ম্যাকিনলি অভিযানে তাঁর দুই হাতের দশটি আঙুলই ফ্রস্ট বাইটে (তুষার কামড়) কাটা পড়েছে। হাতের দশ আঙুল ছাড়াই তিনি এখন পর্যন্ত এভারেস্ট, কে-টুসহ সাতটি ৮ হাজার মিটারের পর্বত ও সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ সাতটি চূড়া (সেভেন সামিট) আরোহণ করেছেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও বন্ধুভাবাপন্ন চমৎকার একজন মানুষ কিম। তাঁর সঙ্গে গল্প হয় বিভিন্ন অভিযান নিয়ে।
জোত ইরোসের সঙ্গেও পরিচয়টা তখনই। সেবারও তিনি বোতলজাত অক্সিজেন ছাড়াই কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করতে বেরিয়েছিলেন। জোত প্রথম হাঙ্গেরিয়ান হিসেবে এভারেস্ট আরোহণ করেন। ২০১০ সালের বসন্তে তাতরা পর্বতমালায় অভিযানকালে অ্যাভালাঞ্জে (তুষারধস) মারাত্মকভাবে আহত হলে তাঁর ডান পায়ের হাঁটু থেকে নিচের অংশ কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু পা হারিয়েও তিনি বিন্দুমাত্র দমে যাননি। কৃত্রিম পা লাগিয়ে তিনি সেই বছরই শরতে পৃথিবীর ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ চো-য়ু অভিযানে যান। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ার জন্য অভিযান সফল হয়নি। পরের বছরই মে মাসে তিনি কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে পৃথিবীর চতুর্থ উচ্চতম পর্বত লোৎসে আরোহণ করেন। অনুপ্রেরণাদায়ী অসাধারণ একজন পর্বতারোহী এই জোত। এই অসাধারণ সব মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি নিজে সমৃদ্ধ হই। পর্বতারোহণ এমন এক ক্রীড়া, যেখানে শরীর ও মনের সব শক্তি সমন্বিতভাবে কাজ করে। আমি মনে করি অন্য যেকোনো ক্রীড়ার ক্রীড়াবিদদের চেয়ে পর্বতারোহীরা তাঁদের কাজ ও কথার মাধ্যমে মানুষকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করতে পারেন। কারণ প্রত্যেক বিখ্যাত পর্বতারোহীর জীবনই দীর্ঘ সংগ্রামের জীবন

লেখক: দুবার এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি