গৃহকর্মী থেকে মাইক্রোসফটের দূত ফাতেমা

মাইক্রোসফটের শুভেচ্ছাদূত ফাতেমা বেগম। ছবি: সংগৃহীত
মাইক্রোসফটের শুভেচ্ছাদূত ফাতেমা বেগম। ছবি: সংগৃহীত

‘আমার দিকে তাকাবে।’
‘হাসিখুশি মন নিয়ে কথা বলবে।’
‘আমার নাম ফাতেমা...’
একটি প্রামাণ্যচিত্রের প্রথম তিনটি বাক্য এমনই। প্রামাণ্যচিত্রটি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর ১৬ বছর বয়সী ফাতেমা বেগমের। বিশ্বখ্যাত সফটওয়্যার নির্মাতা মাইক্রোসফট তাকে বানিয়েছে শুভেচ্ছাদূত। আর ইউটিউবে মাইক্রোসফট এশিয়া এই প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচার করছে। ফাতেমা এখন অনেক মেয়ের কাছেই অনুপ্রেরণা। অথচ এই ফাতেমাকে করতে হয়েছে গৃহকর্মীর কাজ, তার বাল্যবিবাহের আয়োজনও সম্পন্ন হয়েছিল।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তসংলগ্ন গ্রাম নাখারগঞ্জ। সরেজমিনে দেখা গেল, গ্রামের বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ৫ শতাংশ জমির ওপর ফাতেমাদের বাড়ি। সম্পদ বলতে এটুকুই। বাড়িতে দুটি ঘর। দেখেই বোঝা যায়, দারিদ্র্য এখনো যায়নি।

বাড়িতে ফাতেমার বাবা দিনমজুর আয়নাল হককে পাওয়া গেল না। কাজে গেছেন। ফাতেমা তার মা ফরিদা বেগমের সঙ্গে সংসারের কাজ করছিল। ফাতেমা জানাল, সে দক্ষিণ রামখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করত। অধিকাংশ দিন না খেয়ে চার কিলোমিটার হেঁটে বড় বোন আমেনার সঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা করত। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে বড় বোন আমেনার বিয়ে হয়ে যায়। তার বিয়ের খরচ জোগাতে সুদের ওপর টাকা ধার করতে হয় বাবাকে। আরও সংকটে পড়ে তারা।

ফাতেমা বলে, ‘অভাবের কারণে ওই সময় আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। আমি অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নিই। তখন আমার বয়স নয় বছর। কাজ করে বাড়িতে টাকা দিতাম। ওই পরিবারের ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যেত, খুব কষ্ট পেতাম। ওরা পড়তে বসলে আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। রাতে ওদের বই নিয়ে পড়তাম।’

দুই বছর এভাবে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে থাকে ফাতেমা। একদিন বাবা ফাতেমাকে ডেকে পাঠান বাড়ি। ‘আমার মনে হয়েছিল আবার স্কুলে ভর্তি করে দেবে। খুব খুশি হয়েছিলাম।’ বলে চলে ফাতেমা। সেই ডাকে বাড়িতে এসে ফাতেমা দেখল ২৫ বছর বয়সী একজনের সঙ্গে তার বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন। ফাতেমার বয়স তখন ১১ বছর। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এ সময় স্থানীয় আশার আলো পাঠশালার পরিচালক বিশ্বজিৎ বর্মণসহ সংগঠনের কয়েকজন যুবক এসে এই বিয়েতে বাধা দেন। ফাতেমার বাবাকে বোঝান বাল্যবিবাহ দেওয়া ঠিক না। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। ফাতেমাকে বিনা পয়সায় লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব নেয় আশার আলো পাঠশালা। ফাতেমা বলে, ‘তাঁদের সহযোগিতায় ও আমার মায়ের ইচ্ছায় আশার আলো পাঠশালায় ভর্তি হই। পাঠশালায় এসে নতুন জীবন ফিরে পাই।’

অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ফাতেমা
অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ফাতেমা

ফাতেমা এখন নাগেশ্বরী রায়গঞ্জ ডিগ্রি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি মাইক্রোসফট অফিস ও কম্পিউটার গ্রাফিকস ডিজাইনে দক্ষ সে। আশার আলো পাঠশালার কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজও করছে ফাতেমা। সে মেয়েদের কম্পিউটার শেখায়। ফাতেমার ছোট দুই বোন মিষ্টি ও আলমিনা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

মাইক্রোসফট বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও লাওসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোনিয়া বশির কবির মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশার আলো পাঠশালার অংশীদার ইয়াং বাংলা। তাদের আগ্রহে আমরা এই পাঠশালায় যাই। তখন ফাতেমা আমার সঙ্গে ইংরেজিতে এত সাবলীলভাবে কথা বলে যে মুগ্ধ হয়ে যাই। আশার আলো পাঠশালায় কম্পিউটার ল্যাব করে দেয় মাইক্রোসফট। ফাতেমাসহ অনেক মেয়েই শেখে তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয়।’

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মাইক্রোসফটের তত্ত্বাবধানে ফাতেমাকে নিয়ে তৈরি হয় একটি প্রামাণ্যচিত্র। এরপরই তাকে ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ মনোনীত করা হয়। আশার আলো পাঠশালার পরিচালক বিশ্বজিৎ বর্মণ জানান, ফাতেমা শুভেচ্ছাদূত হওয়ায় তাঁরা খুব খুশি। বলেলন, ‘এটা ইয়াং বাংলার জন্য সম্ভব হয়েছে। ফাতেমাকে দেখে গ্রামের মেয়েরা লেখাপড়া ও কম্পিউটার শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।’

ফাতেমার ইচ্ছা লেখাপড়া শেষ করে বাল্যবিবাহ রোধে সবাইকে নিয়ে কাজ করার। ফাতেমা বলে, ‘সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করতে চাই। তাই এখন আমি শিখে চলেছি।’