তারকাদের পাতে আসিফের রান্না

>

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন পার্কে আসিফ মামুন। ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন পার্কে আসিফ মামুন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের আসিফ মামুন অস্ট্রেলিয়ায় এক অতিথিসেবা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শেফ। নিজ প্রতিষ্ঠানের হয়ে টেনিস খেলার জমকালো আসর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে আসা খেলোয়াড়-কোচ-কর্মকর্তা-সংবাদকর্মী-দর্শকদের আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করেন। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সামাল দিতে তিনি নেতৃত্ব দেন ৩০০ জন কর্মীর একটি দলের। তাঁর রান্না করা খাবার খেয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনসহ হলিউড তারকা টম ক্রুজ, উইল স্মিথসহ অনেকেই। আসিফের কৃতিত্বের কথা লেখা হয়েছে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডসহ অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে। জেনে নিন তাঁর কথা। 

তাঁর দেখা সহজে মিলবে না, সে আগেই বুঝেছি। তাই বলে রীতিমতো যে অভিযানে নামতে হবে, সেটাও ছিল ধারণার বাইরে। কারণ, তিনি না ফেসবুকে সক্রিয়, না তাঁকে পাওয়া যায় কোনো সামাজিক মাধ্যমে। যদিও লিংকড-ইনে তাঁর নামে একটি প্রোফাইল আছে; কিন্তু যোগাযোগের নম্বর পেতে খরচ করতে হবে অর্থ। অবশেষে দ্বারস্থ হলাম মেলবোর্নে থাকা পরিচিতজনদের। জানা ছিল, অস্ট্রেলিয়ার এ শহরেই থাকেন শেখ আসিফ মামুন। এই বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠিত একজন রন্ধনশিল্পী। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অতিথিসেবা প্রতিষ্ঠান ডেলাওয়্যার নর্থের অস্ট্রেলিয়া শাখার প্রধান শেফ তিনি।

আসিফ মামুন
আসিফ মামুন

তাঁর কৃতিত্বের কথা পড়েছি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ডসহ বেশ কিছু পত্রিকায়। জানুয়ারি মাসে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত হলো টেনিসের জমকালো আসর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন-২০১৮। টেনিসের এ আসরে বিশ্বের নামীদামি খেলোয়াড়েরা অংশ নেন। দুই সপ্তাহের টুর্নামেন্টে রজার ফেদেরার-রাফায়েল নাদালের মতো তারকারা আলো ছড়ান মেলবোর্ন পার্কের টেনিস কোর্টে। তবে খেলার নেপথ্য দৃশ্যে থাকেন আরও অনেকে। তাঁদেরই একজন শেখ আসিফ মামুন।

অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের পুরো আয়োজনের খাবারের দায়িত্ব সামলান তিনি। খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা আর সংবাদকর্মীদের খাবারসহ প্রায় ৬৫ হাজার দর্শকের জন্য জলখাবার তৈরির ভারটাও তাঁর ওপর। শুধু তা-ই নয়, খেলোয়াড়দের চাহিদাফর্দ অনুযায়ী তাঁরা কী খাবেন, কতটুকু খাবেন, কোন সময় খাবেন, এমন আরও অনেক বিষয় সামাল দেন আসিফ মামুন। শুধু বিশ্বসেরা টেনিস খেলোয়াড়ই নন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, হলিউড তারকা টম ক্রুজ, উইল স্মিথসহ অনেকেই মুখে নিয়েছেন তাঁর রান্না করা খাবার।

অবশেষ পাওয়া গেল আসিফকে। চলতি মাসেই সহকর্মী হাসান তারিকের সাহায্যে পেলাম আসিফের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর। সিডনি থেকে মেলবোর্নে ফোনে আসিফ মামুনের সঙ্গে আলাপের মুহূর্তে মনে হলো, এ যেন এক সফল অভিযানের সমাপ্তি! ১ মার্চ কুশল আর পরিচয় পর্বের পর তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন সানন্দে।

স্ত্রী মুন সাংহি ও ছেলে নোয়া মামুনের সঙ্গে আসিফ মামুন
স্ত্রী মুন সাংহি ও ছেলে নোয়া মামুনের সঙ্গে আসিফ মামুন

পড়তে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়

আসিফ মামুনদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তবে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার পুরানা পল্টনে। আবদুল হাকিম ও রোকেয়া সুলতানার ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে আসিফ দ্বিতীয়। সেগুনবাগিচা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অর্থনীতিতে স্নাতক হয়ে ২০০১ সালে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে।

বিদেশে এসে রান্নাবান্না শুরু করেছিলেন বাধ্য হয়েই, নিজের জন্য। সেই রান্নাই এখন তাঁর পেশা, ভাবনার জগৎ। আসিফ বললেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর থেকে খাবারের স্বাদকষ্টে ভুগছিলাম। যা খেতাম, তা যেন শুধু ক্ষুধা লাগে বলে খাওয়া। অনেক সময় আবার রান্না করার ভয়ে না খেয়ে থেকেছি। তখন বাধ্য হয়েই মাকে ফোন করে রান্না শিখে নিতাম। খুব ভালো রাঁধতাম কি না জানি না। তবে বন্ধুরা খাবার খেয়ে প্রশংসা করত।’ এভাবেই হেঁশেলে ঢুকে পড়েন আসিফ মামুন।

নিজের রসুইঘরে
নিজের রসুইঘরে

তিনিই এখন প্রধান শেফ

তারপর রান্নার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা। তবে তখনো শেফ হওয়ার কোনো চিন্তাই ছিল না আসিফ মামুনের। বললেন, ‘ধারণাও ছিল না রান্না করে বড় কিছু হওয়া যায়।’

একসময় আসিফ মামুন ভর্তি হলেন রান্নার কোর্সে। গিয়েছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়তে কেমব্রিজ কলেজে, এরপর ভর্তি হলেন উইলিয়াম অ্যাঙ্গেলস কলেজে রান্নাবিষয়ক ডিপ্লোমা কোর্সে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে রান্না শিখেছেন মেলবোর্নের ক্রাউন কেসিনোর রেস্তোরাঁয়। প্রথম চাকরিটাও সেখানে। কাজের আমন্ত্রণ পেয়েছেন মেলবোর্নের বিভিন্ন হোটেল থেকে। কাজ করেছেন নামী রন্ধনশিল্পী নোবু মাতসুহিসা, জেমি অলিভার, বিল গ্রেঞ্জারসহ অনেকের সঙ্গে। সেরাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে রান্নার হাত পোক্ত করেছেন তিনি।

২০১১ সাল থেকে কাজ করছেন ডেলাওয়্যার নর্থ প্রতিষ্ঠানের অস্ট্রেলিয়া শাখায়। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বজুড়ে বড় বড় আয়োজনের খাবারসহ অতিথি ব্যবস্থাপনা করে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় চারটা টেনিস খেলার আসরের তিনটিরই অতিথি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে ডেলাওয়্যার নর্থ প্রতিষ্ঠানটি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের কাজটিও তারাই করে থাকে। বর্তমানে প্রধান শেফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

তাঁর দলে কাজ করেন ৩০০ কর্মী। মামুন বললেন, ‘আমি যখন খাবারের তালিকা তৈরি করি, তখন মাথায় রাখি কার জন্য খাবারটি তৈরি করছি। আমি রান্নাকে শিল্প মনে করি। আমার ক্যানভাস রান্নাঘর। আমার রংতুলি হলো ফলমূল শাক-সবজি আর মাছ-মাংস।’

মেলবোর্ন পার্কে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রীড়া ও পর্যটনমন্ত্রী জন এরিন (ডানে) ও দেশটির টেনিস দলের টম লেমারের সঙ্গে আসিফ মামুন (মাঝে), ২০১৭
মেলবোর্ন পার্কে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রীড়া ও পর্যটনমন্ত্রী জন এরিন (ডানে) ও দেশটির টেনিস দলের টম লেমারের সঙ্গে আসিফ মামুন (মাঝে), ২০১৭

বিল ক্লিনটনের প্রশংসা, ফেদেরারের সঙ্গে খোশগল্প

২০১১ সালের দিকে ক্রাউন কেসিনোতে চাকরি করতেন আসিফ মামুন। এই ভিলাতে দুই রাত ছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন। সে ভিলার খাবারের দায়িত্বে ছিলেন আসিফ। সেখানেই ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা। তাঁর হাতের বিশেষ গ্রিল চিকেন ও সালাদ খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন ক্লিনটন। হাসিমাখা কণ্ঠে বলছিলেন সে গল্প, ‘পেশাগত কাজে আবেগ থাকতে নেই। তবে যেদিন বিল ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা হলো, সেদিন অন্য রকম লেগেছিল। কাজ থেকে বের হয়ে ইচ্ছা হচ্ছিল সবাইকে বলি, ক্লিনটন আজ আমার খাবারের প্রশংসা করেছেন।’

বিশ্বসেরা টেনিস খেলোয়াড় রজার ফেদেরার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্য তৈরি হয়েছে। প্রায়ই কথা হয়। কর্মক্ষেত্রে মজার ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ফেদেরারকে বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে চেনে। তিনি তো বিশ্বাসই করতে চাইলেন না।’

টেনিস তারকা ছাড়াও এ বছরই তাঁর হাতের রান্না খেয়েছেন হলিউড তারকা উইল স্মিথ, উইল ফেরেল। আগে একবার টম ক্রুজও তাঁর হাতের খাবার খেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন।

সহকর্মীদের সঙ্গে আসিফ মামুন
সহকর্মীদের সঙ্গে আসিফ মামুন

আসিফের সেরা দশ

একটি বিশেষ খাবারের তালিকা তৈরি করেছেন তিনি। এই তালিকা টেনিস তারকাদের জন্য। রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকাভিচ, গারিবিন মুগুরুজা, ক্যারোলিন ওজনিয়াকিরাসহ বিশ্বসেরা ১০ জন টেনিস খেলোয়াড়ের জন্য বিশেষ খাবারের তালিকার নাম ‘সেরা দশ’। এই তালিকা এতটাই বিশেষ যে শুধু তাঁদের রান্নার জন্য আলাদা করে দুজন অভিজ্ঞ রাঁধুনি নিয়োগ দিয়েছেন মামুন। বললেন, ‘সেরা দশের জন্য খাবার তৈরি করতে ডায়েট বিষয়ে অভিজ্ঞ দুজন শেফ আছে আমার।’

আসিফের প্লেয়ার্স ক্যাফে

মেলবোর্ন অলিম্পিক পার্কে খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্যাফে এটি। এখানে খাবার থেকে শুরু করে বিনোদন, আরাম করার সুবিধা রয়েছে। এই ক্যাফের ধারণাও আসিফ মামুনের। এখানে থাকে বিশেষ ঐতিহ্যগত খাবার; যেমন অস্ট্রেলিয়ার যেখানে যেটা বিখ্যাত, সেখান থেকে এনে সে রকম পরিবেশে পরিবেশন করা।

পরিবারই শেষ কথা

কোরীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় স্ত্রী মুন সাংহি ও চার বছর বয়সী ছেলে নোয়া মামুনকে নিয়ে আসিফের সংসার। স্ত্রীও পেশায় শেফ। এখন ছেলে নিয়েই সময় কাটে তাঁর। পেশাগত জীবন নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকেন আসিফ মামুন। তবে শত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলাদেশে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি। প্রতি এক বছর অন্তর দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন; গিয়েছিলেন গত বছরও।

ছেলেকে নিয়ে গর্ব

ছেলেকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই আসিফ মামুনের বাবা আবদুল হাকিমের। তবে প্রথম দিকের অবস্থাটা এমন ছিল না। তিনি যেমনটি বলছিলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন ছিল, উচ্চশিক্ষা নিয়ে ছেলে ভালো কিছু করবে। এমন স্বপ্ন থেকেই তো মামুনকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। যখন শুনলাম ও রান্না নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে, তখন হতাশ হয়েছিলাম।’ শুধু হতাশই হননি, ভাবতেন তাঁর ছেলে বিদেশে গিয়ে বাবুর্চি হয়েছে! ছেলে কী করেন, পরিচিতদের সেটা বলতেও দ্বিধা কাজ করত।

আসিফ মামুনের মা রোকেয়া সুলতানা ফোনে বলেন, ‘আমাদের ভুল ভাঙল অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম মামুনকে দেখতে গিয়ে। বুঝলাম, ব্যাপারটা আলাদা, এ রান্না সে রান্না নয়। এ পেশায় সুনাম আছে, উঁচুমানের সম্মান আছে সমাজে।’ তখন ছেলের কাজ নিয়ে গর্ব হয়েছিল মা–বাবার।