জীবন গড়ার শিক্ষা

বিএনসিসির সদর দপ্তরে চলছে কুচকাওয়াজের মহড়া। ছবি: খালেদ সরকার
বিএনসিসির সদর দপ্তরে চলছে কুচকাওয়াজের মহড়া। ছবি: খালেদ সরকার

ছাত্রজীবনে যাঁরা বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁদেরও নিশ্চয়ই কখনো না কখনো বিএনসিসির ক্যাডেটদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বিভিন্ন বিশেষ দিবসের কুচকাওয়াজে এই তরুণদের আপনি হয়তো এক তালে পা ফেলতে দেখেছেন। হয়তো আপনাদের দেখা হয়েছে স্টেডিয়াম বা জাতীয় স্মৃতিসৌধে। খেলাধুলা, উৎসব, পার্বণ বা বিশেষ দিনগুলোতে হট্টগোলের মধ্যে যখন একজন আরেকজনের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, এই ক্যাডেটরাই ঠায় দাঁড়িয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। যেকোনো দুর্যোগেও আপনি বিএনসিসির ক্যাডেটদের দেখা পাবেন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে তাঁরা হাজির হয়ে যান মানবসেবার ব্রত নিয়ে।

এসবই তাঁদের স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমের অংশ। এসবের মধ্য দিয়ে তাঁরা শৃঙ্খলা, জ্ঞান, একতা, নেতৃত্ব, নৈতিকতার পাশাপাশি মানবিক গুণাবলির চর্চা করেন। একই সঙ্গে কঠোর এবং কোমল হতে শেখেন। বিএনসিসির প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে এই তরুণেরা ভীষণ পরিশ্রম করেন, আবার ক্যাম্প শেষে বাড়ি ফেরার সময় একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। নন-ক্যাডেটদের জন্য আসলে এই অনুভূতি বোঝা খুব কঠিন।

দেশে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে বিএনসিসি। তাই সেনা, নৌ ও বিমান—তিনটি ভিন্ন উইংয়ের মাধ্যমে ক্যাডেটদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বর্তমানে সেনা উইংয়ের অধীনে পাঁচটি রেজিমেন্ট, নৌ-উইংয়ের অধীনে তিনটি ফ্লোটিলা এবং এয়ার উইংয়ের অধীনে তিনটি এয়ার স্কোয়াড্রন কাজ করছে। দেশের ৫২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্লাটুন আছে মোট ৬৫১টি। বিএনসিসির সদর দপ্তর থেকে জানা গেল, আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ক্যাম্পাসে বিএনসিসি চালু করতে আগ্রহী। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল, প্রশিক্ষক ও জায়গার অভাবে শিগগিরই সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

বদলে যাওয়া জীবন

নানজীবা খান একটি ফ্লাইং স্কুলে পড়ছেন। এখন তিনি ট্রেইনি পাইলট। তাঁর আকাশে ওড়ার স্বপ্নটাকে বেগ দিয়েছিল বিএনসিসির কার্যক্রম। কলেজে পড়ার সময় ক্যাডেট সার্জেন্ট ছিলেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের প্রতিনিধি হিসেবে ভারত ঘুরে এসেছেন গত বছর। বলছিলেন, ‘ক্যাম্পের প্রশিক্ষণে রাইফেল চালানো শিখেছি। ফায়ার করার সময় কাঁধে একটা ধাক্কা লাগে। এই ধাক্কাই আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।’ বিএনসিসি থেকে পাওয়া এই আত্মবিশ্বাস যে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা বদলে দেয়, সে কথা বলল বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র সামিন ইহ্সান। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সে। স্কুলে নাকি খুব সাধারণ ছাত্র ছিল সামিন। ক্লাস, পরীক্ষা, পড়ালেখার বাইরে আর তেমন কোনো পরিচয় ছিল না। বিএনসিসিতে যুক্ত হওয়ার পর সে অনেকটা বদলে গেছে। শৃঙ্খলাবোধ আর নেতৃত্বের শিক্ষা তো আছেই। ক্যাডেটদের বিভিন্ন আয়োজনে নাটক, উপস্থিত বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েও নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে সামিন। গত বছর ঘুরে এসেছে নেপাল থেকে। সেখানে তার নানা দেশের ক্যাডেটদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এখনো ভিনদেশি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। সামিন বলছিল, ‘পোখারার একটা হোটেলে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। সেখানে ভারতীয়, নেপালি ক্যাডেটদের সঙ্গে অনেক গল্প হয়েছে। ওরা আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী। আমরা বাংলাদেশের ১২ জন ক্যাডেট ওদের সামনে নিজের দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরেছি। ওরাও ওদের সংস্কৃতি তুলে ধরেছে। একে অপরের ভালো দিকটা গ্রহণ করাই এই সফরের উদ্দেশ্য।’

খাঁটি সোনা বনাম নকল সোনা

দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী যেখানে জিপিএ-৫-এর পেছনে ছুটছে, সেখানে এই কিশোর-তরুণদের স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম অনেকের কাছে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ মনে হতে পারে। ভাবতে পারেন, পড়ালেখার পাশাপাশি এই শরীরচর্চা, অস্ত্র প্রশিক্ষণ, ড্রিল, নেতৃত্বের শিক্ষা, সামাজিক কার্যক্রম...কী দরকার? এর চেয়ে একটা ‘গোল্ডেন’ জিপিএ-৫ই তো জীবনের বড় অর্জন! ক্যাডেটদের সঙ্গে কথা বললে বুঝবেন, ‘খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা, সেজন সোনা চেনে না।’

বিএনসিসির কার্যক্রম কীভাবে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে, সেটা আরও পরিষ্কার হলো আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. এনামুল হক তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে। তিনি বিএনসিসির একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট (বিটিএফও)। আনন্দ মোহন কলেজের ক্যাডেটদের নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই কাজ করছেন। বলছিলেন, ‘মানুষের জীবনে তিন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন। বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় এবং মনোপেশিজ। বুদ্ধিবৃত্তীয় দক্ষতা তৈরি হয় বই পড়ে। আবেগীয় দক্ষতা তৈরি হয় মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমে। আর মনোপেশিজ দক্ষতার জন্য হাতে-কলমে কাজ করতে হয়। প্রথম দক্ষতাটা আপনি হয়তো স্কুল-কলেজের পড়ালেখা থেকে পাবেন। কিন্তু পরের দুটোর জন্যই বিএনসিসির কার্যক্রম প্রয়োজন।’

জানা গেল, যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রতিবছর বিএনসিসির ৪৮ জন ক্যাডেট বিদেশভ্রমণের সুযোগ পান। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপে গিয়ে তাঁরা অন্যান্য দেশের ক্যাডেটদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সশস্ত্র বাহিনীতেও বিএনসিসির ক্যাডেটদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের মতো বিএনসিসির ক্যাডেটরাও মৌখিক পরীক্ষা পেরিয়ে সরাসরি আইএসএসবি (ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড) পরীক্ষা দিতে পারেন। প্রতিবছর ৩০০ জন বিএনসিসি ক্যাডেট সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে ভর্তির সুযোগ পান। এ ছাড়া পড়ালেখায় ক্যাডেটদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিএনসিসি সদর দপ্তর থেকে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ পাঁচ প্রাপ্তদের বৃত্তি দেওয়া হয়।

>
এক নজরে বিএনসিসি

মূলমন্ত্র: জ্ঞান ও শৃঙ্খলা

বিএনসিসির দায়িত্ব: দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে সেবা প্রদানের জন্য প্রস্তুত থাকা, দুর্যোগ মোকাবিলা, সশস্ত্র বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করা এবং সরকার অর্পিত অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করা

দেশের ৫২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিএনসিসি আছে

বর্তমানে মোট ক্যাডেটের সংখ্যা: প্রায় ২৫ হাজার

১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডেট: প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার

সারা দেশে মোট প্লাটুন: ৬৫১ টি

উইং: বিমান, নৌ ও সেনা