সারা জগৎ এক হয়ে গেছে

>

গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব (জি সি দেব) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনবিদ্যার অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছিল, তার বলি হয়েছিলেন এই গুণী মানুষটি। পরে তাঁর স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গোবিন্দ দেব গবেষণা কেন্দ্র। স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের জন্য আজ ‘দর্শন ও একজগৎ’ শিরোনামে জি সি দেবের লেখা একটি প্রবন্ধের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো। কত বছর আগে তিনি এসব কথা লিখে গেছেন! অথচ মনে হয়, তিনি যেন আজকের পৃথিবীতেই দাঁড়িয়েই এসব কথা বলছেন

আজকের দিনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সব দেশের সব মানুষকে এক আদর্শে অনুপ্রাণিত করে এক জগৎ গড়ে তোলা, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমরা সেই আদর্শ থেকে এখনো এত দূরে। অনেক বছর আগে থিওডোর রুজভেল্ট বলেছিলেন অন্য দেশকে ভালোবাসা পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তিরই শামিল। সংকীর্ণ-দৃষ্টি স্বাদেশিকতা আজ আমাদের বাঁচাতে পারে না। বিজ্ঞানের প্রভাবে দেশ-কালের দূরত্ব অভাবনীয় রূপে কমে গেছে। বাইরের দিক দিয়ে সারা জগৎ এক হয়ে গেছে। তথাগত বুদ্ধ দু’হাজার পাঁচ শ বছর আগে যেদিন এই উপমহাদেশেরই এক প্রান্তে নির্বাণ ও অহিংসার বাণী প্রচার করছিলেন ঠিক সেই সময়েই ইতালির এক দ্বীপে মনীষী পিথাগোরাস তাঁর গাণিতিক অতীন্দ্রিয়বাদ ও সন্ন্যাসের মন্ত্র প্রচার করছিলেন। কিন্তু এঁদের দু’জনের কেউ কাউকে জানতেন না। আর আজ ঘরে বসে আমরা হাজার হাজার মাইল দূরের বক্তৃতা শুনতে পাচ্ছি, এমনকি বক্তার চেহারা পর্যন্তও দেখতে পাচ্ছি। আজকের দিনে বিজ্ঞানের মতে দেশকালের মান আপেক্ষিক। যদি তাই হয় তবে আজ যখন হাজার মাইল আকাশ-পথে অতিক্রম করতে গড়পড়তা দু’তিন ঘণ্টা লাগে আর গরুর গাড়িতে যেতে যখন এক মাসেরও বেশি লাগে তখন বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে আগেকার যুগের এক মাসেরও বেশি সময় আজকের দিনের দু’তিন ঘণ্টার সমান। তাই বলছিলাম বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় উন্নতিতে দেশকালের ব্যবধান আমরা এমনভাবে অতিক্রম করেছি যে আজ আর জগৎকে এক সূত্রে গেঁথে দেখা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। আজ যদি কোনো দেশ বা মানবগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বিদ্যুৎ হয়ে আত্মকেন্দ্রিক জীবন যাপনে উৎসুক হয় সে চেষ্টা নিশ্চয়ই বিফল হবে। বারানসী হিন্দু পৌরাণিকদের মতে পৃথিবীর অন্তর্ভুক্ত হয়েও শিবের ত্রিশূলের ওপর অবস্থিত। আজ যদি আমরা এক দেশকে আর এক দেশ থেকে, এক জাতকে আর এক জাত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভেবে পায়রার খোপের ন্যায় ছোট ছোট খোপে বিভক্ত করি তবে সমস্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিবের ত্রিশূলের ওপর আমাদের ঝুলে থাকতে হবে।

জগতের এই ঐক্য বাহ্যিক, আন্তরিক বা আত্মিক নয়। তাই নানা সমস্যায় আমরা জর্জরিত। দুটি বিশ্বযুদ্ধ আমাদের জীবিতাবস্থায়ই অতি অল্পদিনের ভেতর মানব-সভ্যতার ওপর গুরুতর আঘাত হেনে গেল। আবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় আমাদের হৃদয় অবসন্ন। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে সমরায়োজন পুরোদমে চলছে। অনেকের মতে ভাবী বিশ্বযুদ্ধ যদি সত্যই সংঘটিত হয় তারপর মানব-সভ্যতার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। গোর্কি গ্রাম্য লোকের মারফত তাঁর এক গল্পে বলেছেন বিজ্ঞান আমাদের পাখার ন্যায় অবাধ গতিতে আকাশে উড়তে শিখিয়েছে, মাছের মতো জলে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছে, কিন্তু পৃথিবীতে শান্তিতে বাঁচতে শেখায়নি। এইটি হলো মূল সমস্যা। এটা যে বিজ্ঞানের দোষ তা নয়। বছর কয় আগে এক খ্রিস্টান ধর্মযাজক এই সমস্যার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন পঞ্চাশ বছরের মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণা বন্ধ করে দিতে। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই; কিন্তু বিজ্ঞানের অপব্যবহারের দোষ বিজ্ঞানের কাঁধে চাপানো নিরর্থক। বৈজ্ঞানিক শক্তির সদ্ব্যবহার করার মতো মনোবৃত্তি আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। তবেই বিজ্ঞান আমাদের নিয়ে যাবে অবিমিশ্র কল্যাণের পথে। তবেই পরিত্রাণ পাব আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের হাত থেকে। এই জন্য চাই সব রকম সংকীর্ণ দৃষ্টি পরিত্যাগ করে জগতের সব দেশের সব মানুষের ভেতর প্রেম স্থাপন করা।

সূত্র: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ—জি সি দেব