স্টিফেন হকিংয়ের প্রভাব বাংলাদেশে কতটা?

>
দ্য সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের কার্যালয়ে স্টিফেন হকিং। ছবি: সংগৃহীত
দ্য সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের কার্যালয়ে স্টিফেন হকিং। ছবি: সংগৃহীত
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড দলের কোচ মাহবুব মজুমদার। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত অনুষদের ‘ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড থিওরিটিক্যাল ফিজিকস’-এ পিএইচডির ছাত্র ছিলেন। সে সময় কাছ থেকে দেখেছেন স্টিফেন হকিংকে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, কীভাবে এই বিখ্যাত পদার্থবিদ বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ওপর প্রভাব ফেলেছেন

১৪ মার্চ, পাই দিবস, এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে আলবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্যবশত এই দিনেই এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মৃত্যুবরণ করলেন। তিনি যেমনভাবে একটি বিশেষ দিনে মৃত্যুবরণ করেছেন, তেমনি তাঁর জন্মও হয়েছিল একটি বিশেষ দিনে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর ৩০০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশেষ দিনে জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করা এই পদার্থ বিজ্ঞানী শুধু মহাকর্ষীয় পদার্থবিজ্ঞানেই অবদান রাখেননি, তাঁর অতুলনীয় অবদান রয়েছে সমগ্র বিশ্বে। পৃথিবীর আরও অনেক মানুষকে বিজ্ঞান ও গণিতে আগ্রহী করে তোলার মাধ্যমে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।

আমি যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন স্টিফেন হকিংয়ের অফিস এবং আমার অফিস একই তলায় ছিল। দূরত্ব কেবল কয়েকটি বারান্দার। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলা কষ্টকর ছিল। কারণ তিনি কম্পিউটার ব্যবহার করে কথা বলতেন, যদিও তিনি আমার মতো সব ছাত্রের সঙ্গেই কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন। আমি কেমব্রিজের গবেষক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ‘স্ট্রিং তত্ত্ব’ ছিল পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম জনপ্রিয় বিষয়। কিন্তু স্টিফেন হকিং কোনো এক অজানা কারণে এই তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। তাই স্ট্রিং তত্ত্বের একজন গবেষক হিসেবে হকিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন কখনো সেভাবে অনুভব করিনি। কিন্তু আমি গভীরভাবে তাঁর কাজ ও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলাম।

অতি উচ্চশক্তির পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে স্ট্রিং তত্ত্বের গবেষকেরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে বিষয়টির দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন তা হলো, ‘ব্ল্যাক হোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স’। এটিকে হকিংয়ের জন্ম দেওয়া বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। এ বিষয়টি ‘হকিংস প্যারাডক্স’ নামেও বহুল পরিচিত। এমনকি বাংলাদেশে আমার অনেক ছাত্র বুয়েট এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিষয়ের ওপর তাদের গবেষণাপত্র লিখেছে। উদাহরণস্বরূপ, বুয়েটের মিশকাত আল আলভী, অভিক রায়, মইনুল হাসান রাহাত তাদের গবেষণা প্রবন্ধ ‘কোয়ান্টাম ইনফরমেশন, থিওরিটিক অ্যানালাইসিস অব ব্ল্যাক হোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স’ লিখেছে হকিংয়ের বহুল পরিচিত ‘ব্ল্যাক হোলের তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের তত্ত্ব’ ব্যবহার করে। পরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিফাত এবং আশিক রহমান তাদের গবেষণা প্রবন্ধে এই একই তত্ত্ব ব্যবহার করে। এমনকি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের সাদ্দাত হাসান, পারেশা ফারাস্তু, রাফিদুজ্জামান সনেট এবং সন্দীপন পাল তাদের দলীয় গবেষণা প্রবন্ধ ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং অ্যানালাইসিস অব কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম’-এ স্টিফেন হকিংয়ের তত্ত্ব ব্যবহার করেছে।

যখন আপনার কোনো কাজ অথবা তত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞানের মৌলিক শাখা যেমন পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও কম্পিউটারবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়নশীল দেশের ছাত্ররা গবেষণার কাজ করে, তখন আসলে এটা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে আপনি বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক সমাজে অনেক বড় অবদান রেখেছেন। ‘ব্ল্যাক হোল ফিজিকস’, ‘কোয়ান্টাম ইনফরমেশন’, ‘আরলি ইউনিভার্স কসমোলজি’ অবশ্যই স্টিফেন হকিংয়ের মৌলিক কাজ, যেগুলো এখন বিশ্বের সব জায়গায় পড়ানো হয়। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো তিনি একটি নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের, যাঁরা কয়েক দশক ধরে গণিতের আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ, ব্ল্যাক হোল ফিজিকস এবং কোয়ান্টাম ইনফরমেশনসহ নানা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

পৃথিবীর বড় বড় আপেক্ষিক তত্ত্ববিদ স্টিফেন হকিংয়ের ছাত্র অথবা সহকর্মী ছিলেন। যেমন গেরি গিবন্স, ডন পেইজ, ক্রিস পোপ, রাফায়েল বসু, কিপ থ্রন ও ম্যালকম পেরি। হকিংকে সেরা তরুণ বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের ‘একাডেমিক পিতামহ’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশি গণিতবিদ মো. আকবর, যিনি বর্তমানে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত, তিনি গ্যারি গিবন্সের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে পেরিমিটার ইনস্টিটিউটে কর্মরত আরেক বাংলাদেশি, স্ট্রিং তত্ত্ববিদ তীব্র আলী ম্যালকম পেরির ছাত্র ছিলেন।

তবে অসাধারণ সৃষ্টিশীল কিছু করার চেয়েও গণিত ও বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে জাতি গঠনের ক্ষেত্রে হকিংয়ের প্রভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টাতেই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণিত অনুষদ—দ্য সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্স (সিএমএস)। সে সময় আমি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির ছাত্র ছিলাম। এটি যুক্তরাজ্যের জন্য গর্ব ও এক বিরাট সম্পদ।

গণিতের মাধ্যমে জাতি গঠনের এই প্রচেষ্টা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ১০ বছর ধরে কাজ করছে ‘বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড’। এই প্রচেষ্টায় আমার সঙ্গে যুক্ত আছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কায়কোবাদ ও মুনির হাসান। আমরা মূলত তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে সাহায্য করছি, যারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তুলবে। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় যেমন এমআইটি, কেমব্রিজ ও হার্ভার্ডের মতো জায়গায় পাঠিয়েছি। বিদেশে পাঠানোর কারণ হলো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী হিসেবে তাদের তৈরি করার মতো অবকাঠামো এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। তবে অসাধারণ প্রতিভাধর শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই বর্তমানে দেশেই অবস্থান করছে। সৌভাগ্যবশত তাদের কেউ কেউ এখন অধ্যয়ন করতে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা নাফিজ ইশতিয়াক ও ওয়াসিফ আহমেদ, বুয়েটের অভিক ও রাহাত, এখন তাদের নিজ নিজ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইতিমধ্যে বিদেশে গিয়েছে। অন্যদিকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার কিছু ছাত্র এ বছর নেদারল্যান্ডসের আটরেকট এবং কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে। আমার বিশ্বাস, তারা ভবিষ্যতে একেক জন উজ্জ্বল তারকা হয়ে ফিরবে।

ইতিমধ্যে গণিত ও বিজ্ঞানে আমাদের অগ্রগতির কিছু ইতিবাচক ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। অনেক শিক্ষার্থীই বিদেশে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসছে এবং দেশের জন্য অবদান রাখা শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, তামান্না ইসলাম উর্মি সম্প্রতি এমআইটি থেকে ফিরে এসেছে। সে ‘গ্রিন এনার্জি’ নিয়ে কাজ করছে এবং আমার অনুরোধে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে। আমি আশা করি, ‘হকিংস সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্স’-এর মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গণিত ও বিজ্ঞান সেন্টার গড়ে তুলে হকিংয়ের জাতি গঠনের এই প্রচেষ্টাকে আমরা অনুসরণ করতে সক্ষম হব। এর মাধ্যমে দেশে বসেই আমাদের তরুণেরা নিজেদের তৈরি করতে এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে।

এটাই স্টিফেন হকিংয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যে আমরা ‘ব্ল্যাক হোল ফিজিকসে’ তার অবদানের বর্ণনা দিয়ে শুরু করেছি এবং শেষ করছি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং শিক্ষায় তাঁর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনার মধ্য দিয়ে। আজকে আমরা তাঁর মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করব এবং একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী এমনকি বাংলাদেশে তাঁর কাজের যে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, তা উদ্‌যাপন করব।