ভিড়ে নারীর হয়রানি হবেই?

বাজারে তো যেতেই হয়। ভিড়ের মধ্যে িনজেকে রক্ষা করাই কঠিন বাস্তবতা। ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন সুমন ইউসুফ
বাজারে তো যেতেই হয়। ভিড়ের মধ্যে িনজেকে রক্ষা করাই কঠিন বাস্তবতা। ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন সুমন ইউসুফ

রাজধানীর চাঁদনি চক মার্কেটে ঢুকতেই মনে হলো যেন জনসমুদ্রে এসে পড়েছি। চাঁদনি চকের প্রধান ফটক ধরে বলাকা সিনেমা হলের কোনার দিকে যেতে যেতে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সতর্ক থাকছিলাম। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে চলতে চলতেই চারপাশে নজর রাখছিলাম। যেন কেউ ছুঁয়ে দিতে না পারে। ব্যাগ জড়িয়ে ধরে এমন আঁকাবাঁকা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম এ অনুভূতি নিশ্চয় একা আমার নয়। ঢাকায় চাঁদনি চক, গাউছিয়ার মতো মার্কেটে এমন ভিড়ের মধ্যে পথ চলতে হয় যেসব মেয়ের, তাঁদেরও নিশ্চয় একই অনুভূতি হয়।

তবে সজাগ থেকেও হয়রানি কতটুকু এড়াতে পারছি আমরা নারীরা। কেনাকাটার এমন জায়গায় ভিড়ের স্রোতে কত ধরনের হয়রানিই না ঘটছে। কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদ করছেন। তবে সে সংখ্যা কয়টি? নারীদের এমন হেনস্তার ঘটনার কতটুকুই বা সামনে আসছে? শাস্তি পাচ্ছে কয়জন অপরাধী?

কয়েক দিন আগে মা, খালা ও বান্ধবীদের নিয়ে চাঁদনি চক মার্কেটে গিয়েছিলেন ইডেন কলেজের একজন শিক্ষার্থী। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাঁরা। ‘শাহনুর ফেব্রিকস’ নামের একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে মেয়েকে নিজের অবস্থান জানান ছাত্রীর মা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই খুঁজতে খুঁজতে দোকানের সামনে চলে আসেন ছাত্রী। এতটুকু সময়েই চরম বিরক্ত দোকানের কর্মচারী। মাকে পারলে ঠেলে ফেলে দেন। চিৎকার করে অভিযোগ করতে থাকেন দোকানে নাকি ক্রেতা প্রবেশ করতে পারছে না। এমন দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করলে শুরু হয় অন্য আক্রমণ। এক জোট হয়ে নোংরা ভাষায় গালাগাল, ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি শুরু করেন দোকানের সব কর্মচারী। হই-হট্টগোল বাড়তে থাকে। আশপাশের লোকজন এগিয়ে না এসে বলতে থাকে, মেয়েদের এত কথা বলার দরকার কী? একপর্যায়ে সীমা লঙ্ঘন করে ছাত্রীর বান্ধবীর পোশাক খামচে ধরে এক কর্মচারী। বলে, ‘দেখি তোর কত তেজ, আয়!’ হ্যাঁচকা টানে কাছে নিয়ে সে কী বীভৎস্যভাবে অপমান। মায়ের শাড়ি ধরেও টান দেয় একজন। পরে বয়স্ক কয়েকজন এসে পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা করে তাদের ওই জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।

ছাত্রী জানান, ওই ঘটনার পুরো বিবরণ দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেই স্ট্যাটাস দেখে একজন সহযোগিতা করেন। তাঁর পরামর্শে নিউমার্কেট থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তাঁরা। এমনকি পুলিশকে সঙ্গে গিয়ে দোকানের ওই কর্মচারীদের চিনিয়েও দেন। পরে চারজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এ বিষয়ে থানায় মামলা হয়েছে। আসামিরা এখন কারাগারে। দোকানটাও বন্ধ আছে।

এটি একটি ঘটনা। এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। তবে কয়জনকে আইনের আওতায় আনতে পারছি আমরা? কতজনই বা প্রকাশ করছেন কষ্টের কথা? হয়রানির স্বীকার কোনো কোনো নারী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মুখ খুলছেন। তবে সেটাও খুব বেশি নয়। দেখা যায় ওই সব পোস্টেও অনেকে ‘মেয়েদের এত মার্কেটে যাওয়ার দরকার কী? এই লজ্জার বিষয় কীভাবে লিখলেন?’ এমন ধরনের মন্তব্য করছেন। আর নারীরা বলছেন, আগের চেয়ে এখনকার সময়ে অনেক বেশি নিরাপত্তা-শঙ্কায় ভোগেন তাঁরা।

সম্প্রতি প্রকাশিত বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অন্তত ৫০ শতাংশ নারী কেনাকাটা করতে গিয়ে অপ্রীতিকর স্পর্শের শিকার হন। অথচ বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি ও হকার্স মার্কেট দোকান মালিক সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে এমন অভিযোগ খুব কমই পান তাঁরা। অ্যাকশনএইডেরপ প্রতিবেদনে বলছে, সামাজিক লজ্জার ভয়ে কেউই কষ্টের কথা বলতে এগিয়ে আসেন না। অভিযোগ করেন না। নারীদের কাছে গিয়ে হয়রানির এই চিত্র জানা গেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বখাটে কর্তৃক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করায় হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯ জন নারী। শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি পত্রিকার তথ্য নিয়ে এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে আসক। অর্থাৎ এতটুকু কেবল প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিত তথ্য আরও অনেক, অনেক বেশি।

হাইকোর্ট ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ ধরনের কর্মকাণ্ডকে যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে রয়েছে সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে অশালীন আচরণ, হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি ও মন্তব্য বা ভঙ্গি। নিউমার্কেট এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে যেসব হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী, তা যৌন হয়রানির মধ্যেই পড়ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাদিয়া ইসলাম (ছদ্মনাম) বললেন, ‘গাউছিয়া মার্কেটে গেলে নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়ি। একবার এমন হয়েছে, একটা কাপড়ের অন্য রং দেখতে চেয়েছিলাম। তখন খুবই নোংরা একটি কথা বলেছিল দোকানি।’ কেন প্রতিবাদ করেননি? সাদিয়া বলেন, ‘মানসম্মান হারানোর ভয়ে চলে আসি। আগে যখন বিশ্বিবদ্যালয়ে পড়তাম চলাফেরা করতে এত ভয় হতো না। এখন দিনের বেলাতেও খুব ভয় হয়।’

এ ব্যাপারটিতে দেশের চিত্র খুবই হতাশাজনক—এমনটাই মনে করেন অ্যাকশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির। তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা না গেলে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ছোট্ট শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যেসব পরিসংখ্যান আসে, সেগুলো আমরা নারীর কাছে গিয়ে জেনে আসি, তথ্য নিই। যৌন হয়রানির কথা কেউ প্রকাশ করতে চায় না। যৌন হয়রানির ঘটনা কমই প্রকাশ পায়। পদ্ধতিগত ব্যবস্থা না নিলে কোনো উন্নয়ন দিয়ে এসব ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা চাপা থাকবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটত। আমরা “কোপিং স্ট্র্যাটেজি” নিয়ে হাঁটতাম। কনুই বাড়িয়ে রাখতাম যাতে কেউ স্পর্শ করতে না পারে। আসলে এসব হয়রানির বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে বড় প্রচার অভিযান চালাতে হবে। বাংলাদেশের সবাইকে জেগে উঠতে হবে। পরিবার হোক, সমাজ হোক, কোনো পর্যায়েই যৌন হয়রানি করা ব্যক্তিদের প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।’

বেশির ভাগ নারীই এসব ঘটনায় মুখ বুজে চলে যান। হয়তো কষ্টে চোখে পানি আসে কিন্তু মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন না। আসলে সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত। প্রতিবাদ করলে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে প্রতিকার পাওয়ার কিছুটা আশা থাকে।

নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা এ রকম অভিযোগ পাচ্ছি। তবে খুব বেশি তা বলব না। যাঁরা সাহসী, তাঁরা অনেক সময় এগিয়ে আসছেন অভিযোগ করতে। কয়েক দিন আগেই এ রকম একটি অভিযোগ পাই। এক নারী বাসে হয়রানির শিকার হয়ে বাসের চালক ও দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আমরা ওই তিনজনকে আটক করেছি। এ ছাড়া সরকারের জরুরি সেবাসংক্রান্ত নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করলেও সংশ্লিষ্ট থানা থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায়।’

কিছু কিছু ঘটনার প্রতিকার হচ্ছে, তা দেখা যাচ্ছে। অভিযোগ পেলে তবেই ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনেও কিছু মামলা হচ্ছে। কয়েকটি মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যেকোনো ধরনের হয়রানির ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ নেয় সমিতি। দোকান বন্ধসহ অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়। তবে হয়রানি কি বন্ধ হচ্ছে? নারীরা কি জনসমাবেশে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন? ভিড়ের মধ্যে কি নিশ্চিতে হেঁটে যেতে পারছেন? গভীরে থাকা চাপা কষ্ট কী কখনো মুছে যাচ্ছে নারীর মন থেকে?