ফুটবলে রঙিন দোহারোর মেয়েরা

শৈলকুপার দোহারো প্রাইমারি স্কুলের এই ফুটবলাররা অপ্রতিরোধ্য। ছবি: শামসুল হক
শৈলকুপার দোহারো প্রাইমারি স্কুলের এই ফুটবলাররা অপ্রতিরোধ্য। ছবি: শামসুল হক

অবসর পেলেই রাস্তার পাশ থেকে কুড়িয়ে আনা নুড়ি-পাথর দিয়ে ‘পাঁচঘুঁটি’ খেলে শৈলকুপার মেয়েরা। ঢাকায় ফুটবল খেলতে এসেও তাহমিনা খাতুন, রুনা খাতুনেরা মজার সেই খেলায় মেতে উঠেছিল মিরপুর ক্রীড়াপল্লিতে বসে! অথচ এক দিন আগেই বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শৈলকুপার দোহারো প্রাইমারি স্কুল। ক্রীড়াপল্লির ওই ঘরের টেবিলের ওপর রাখা চকচকে সোনালি ট্রফি। ট্রফিটা রেখেই ঘরের মেঝেতে ‘পাঁচঘুঁটি’ খেলায় মগ্ন তাহমিনারা।

দৃশ্যটা ২৯ মার্চের। ফুটবলে অমিত সম্ভাবনা থাকতেও একসময় শৈলকুপার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা এমন বিচিত্র খেলাতেই ব্যস্ত থাকত। কিন্তু এই মেয়েদেরই ফুটবল মাঠে নিয়ে এসেছেন কোচ রবিউল ইসলাম। অসাধ্য সাধন করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন দোহারো স্কুলের জয়গাথার গল্প।

গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বঙ্গমাতা ফুটবলের ফাইনালে দোহারো স্কুল হারিয়ে দেয় ময়মনসিংহের নান্দাইলের পাঁচরুখী স্কুলকে। প্রথমবার ফাইনালে উঠেই চমক দেখিয়েছে দোহারোর মেয়েরা। পঞ্চমবারের মতো বঙ্গমাতা আসরে অংশ নিয়ে এত দিন সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল তৃতীয় হওয়া। এবার ফাইনালে উঠেই চ্যাম্পিয়ন।

এই মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন করার কারিগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কোচ রবিউল ইসলাম। অথচ রবিউল জীবনে কখনো বলেই লাথি দেননি! শুধু ফুটবল ফেডারেশনে কয়েক বছর আগে একটি কোচিং লাইসেন্স করেছিলেন। ফুটবল জ্ঞান বলতে এতটুকুই। কিন্তু সেই ফুটবল জ্ঞান আর অধ্যবসায় দিয়ে দোহারোর মেয়েদের বানিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন।

শৈলকুপা থানা সদর থেকে খানিক ভেতরের দিকে দোহারো গ্রাম। মোটরসাইকেলে যেতে প্রায় মিনিট দশেক সময় লাগে। পাশের গ্রাম তেঘরিয়ার শিক্ষক রবিউল দোহারো স্কুলে যোগ দেন ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে। স্কুলে যোগ দিয়েই বাড়তি কিছু করতে চাইতেন। সুযোগটা পেয়ে যান ২০১১ সালে। গ্রামের মেয়েদের ফুটবল খেলানোর স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর স্কুলের মেয়েদের সাফল্য রবিউলের মনে স্বপ্নের বীজ বোনে।

ইউটিউবে বিশ্বের বড় বড় ক্লাবের খেলার ভিডিও দেখেন। ল্যাপটপে রাখেন খেলার ভিডিও। সেগুলো দেখে দেখেই মেয়েদের খেলা শেখান। রবিউল বলছিলেন, ‘প্রথম যেবার বঙ্গমাতা শুরু হলো, আমি ভাবলাম দেখি চেষ্টা করে। আমাদের মেয়েদের যদি ফুটবল খেলাতে পারি, মন্দ হবে না।’ কিন্তু চাইলেই সেটা সম্ভব ছিল না। এলাকার লোকজন মেয়েদের ফুটবল খেলা মোটেও ভালো চোখে দেখেনি। রবিউল ইসলামের বাবা খয়বার আলী মণ্ডলও চাইতেন না মেয়েদের নিয়ে ফুটবলের অনুশীলন করেন রবিউল। বাড়িতে কোনো দিন টেলিভিশনও আনেননি রবিউলের বাবা। কিন্তু ২৮ মার্চ ফাইনালের দিনে সেই বাবাও হাজির হয়েছিলেন টেলিভিশনের সামনে। রবিউল আনন্দে কাঁদেন আর সেই অভিজ্ঞতা বলেন, ‘আমাদের স্কুল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এলাকা থেকে প্রচুর ফোন পেয়েছি। কিন্তু বেশি আনন্দ পেয়েছি বাবার ঘটনাটা শুনে। যে বাবা জীবনে কখনো টেলিভিশন দেখতেন না, সেই তিনিও আমার মেয়েদের খেলা দেখতে বসেছিলেন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।’

ফাইনাল খেলার দিন পুরো শৈলকুপা উপজেলা মেতে উঠেছিল আনন্দে। স্বাধীনতার পর কখনোই কোনো খেলায় এত বড় অর্জন এনে দিতে পারেনি শৈলকুপার কেউ। দোহারো স্কুল সেদিন এক সুতোয় বেঁধে রেখেছিল পুরো শৈলকুপাকে। ফাইনালের দিনে এলাকার সব স্কুলে ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়। চ্যাম্পিয়নের পর এলাকায় বের হয় আনন্দ মিছিল। যেন ‘বিশ্বকাপই’ জিতে ফেলেছে দোহারোর মেয়েরা!

ময়মনসিংহ থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব প্রায় ২৬০ কিলোমিটার। দেশের দুই প্রান্তের দুটি প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুর আর দোহারো। ধোবাউড়া উপজেলার গ্রাম কলসিন্দুরের সঙ্গে শৈলকুপার দোহারোর মিলটা আশ্চর্য রকমের! পিছিয়ে পড়া আর রক্ষণশীল জনগোষ্ঠীর এই দুটি গ্রাম ফুটবল রাঙাচ্ছে ভীষণভাবে।

দোহারো স্কুলের ফুটবলার মেয়েদের কারও বাবা ভ্যানচালক, কারও বাবা কৃষক, তাঁতি। পুরো টুর্নামেন্টে আলো ছড়িয়েছে তাহমিনা খাতুন। সর্বোচ্চ ৭ গোল করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে নিয়েছে গোল্ডেন বুট পুরস্কার। মেয়ের খেলা দেখতে ঢাকায় এসেছিলেন তাহমিনার ভ্যানচালক বাবা। তাহমিনা বাবাকে এতটুকু নিরাশ করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। পুরস্কারের আনন্দ তাই ছাপিয়ে গেছে তাহমিনার, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তুমি একদিন অনেক বড় খেলোয়াড় হবে।’

দোহারো স্কুলের মেয়েদের বাল্যবিবাহ নৈমিত্তিক ঘটনা। অথচ ফুটবল প্রতিভায় মোটেও পিছিয়ে নেই ওরা। আক্ষেপ করে রবিউল বলছিলেন, ‘আমি আরও আগে চ্যাম্পিয়ন হতে পারতাম। কিন্তু আমার যে মেয়েরা একটু ভালো খেলে, খুলনায় বিভাগীয় অঞ্চলে ওদের নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। অথচ কিছুদিন পরই শুনি ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি ওদের ধরে রাখতে পারি না।’

এবার আর বাল্যবিবাহ নয়। শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উসমান গনি এগিয়ে এসেছেন জনসচেতনতায়। এই মেয়েদের ঢাকায় খেলতে আসার পেছনে উৎসাহ দিয়েছেন অক্লান্তভাবে। শৈলকুপায় পৌঁছানোর পর রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে ফুলেল শুভেচ্ছায় মেয়েদের বরণ করে নিয়েছে এলাকাবাসী। যে সাফল্যের সিঁড়িতে সবেমাত্র পা রেখেছে দোহারোর মেয়েরা, সেই সিঁড়িটা আর ভেঙে দিতে চায় না কেউ।