আশফিকার ছবিতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা

আশফিকা রহমান। ছবি: দীপু মালাকার
আশফিকা রহমান। ছবি: দীপু মালাকার

ছবি তুলবেন শত বছরের সিনেমা হলের। ছবিতেও থাকা চাই শতবর্ষের ছাপ। আর তাই খুঁজে খুঁজে তিনি ২০-২৫ বছরের পুরোনো ফিল্ম সংগ্রহ করলেন। ছবি তুললেন—ঝকঝকে ছবি না, হাতে প্রিন্ট করা ছবি, জরাজীর্ণ ছবি। শত বছর আগের ছবি তো এমনই হওয়া উচিত। আলোকচিত্রী আশফিকা রহমানের কাজের ধরনটাই এমন। আলোকচিত্রে তিনি শত কথার গল্প তুলে ধরতে চান। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ ‘জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাস’-এর ফেলোশিপ। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই ফেলোশিপ পেলেন। আগামী সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশনের এই আয়োজনে অংশ নিতে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে যাবেন আশফিকা।

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর প্রয়াত চেয়ারম্যান জুপ সোয়ার্টের নামানুসারে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর এই মাস্টারক্লাস পরিচালিত হচ্ছে। গোটা বিশ্ব থেকে ১২ জন তরুণ সম্ভাবনাময় আলোকচিত্রীকে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ বছর ২১৯ জন তরুণকে প্রাথমিক পর্যায়ে মনোনীত করেন নির্বাচকেরা। এই আলোকচিত্রীদের কাছে তাঁদের কাজের পোর্টফোলিও আহ্বান করা হয়। পোর্টফোলিওতে কাজের ধরন ও ধারাবাহিকতা গুরুত্ব পায়। এ বছর প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে ১০ আলোকচিত্রী মনোনীত হন। তাঁদের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকায় স্থান করে নেন আশফিকা রহমান।

আশফিকার পোর্টফোলিও জুড়ে সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গতকাল শনিবার কথা বলার সময় কারণটা জানান এভাবে, ‘আমার মা সমাজকর্মী। অনেক দিন ধরেই এ কাজ করছেন তিনি। চারপাশে নির্যাতন-নিপীড়ন দেখে আমি বড় হয়েছি। আমার আগ্রহ তাই সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট নিয়ে। আমি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সংকট নিয়ে কাজ করি। আমার আরেকটা কাজ আছে রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলা নিয়ে। পাহাড়ি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়েও কাজ আছে আমার। সবারই একটা কমফোর্ট জোন থাকে। যে বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে জানি, সে বিষয়গুলোতে কাজ করতে আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’

শাস্ত্রীয় নৃত্যে আগ্রহ ছিল বিদ্যালয়পড়ুয়া আশফিকার। ডিপ্লোমাও করেছিলেন। সেটা ২০০১ সালের কথা। পরবর্তীকালে ফিন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ে স্নাতক করেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একই বিষয় বেছে নেন। তবে ছোট থেকে এবেলা পর্যন্ত তাঁর জীবন এক সুতোয় বেঁধেছে ফটোগ্রাফি।

আশফিকা রহমান বলেন, ‘আমার এক কাজিন ছিলেন পেশাদার আলোকচিত্রী, সেই সূত্রে ছোটবেলাতেই শুরু। তবে আমি কখনো পেশা হিসেবে নেওয়ার চিন্তা করিনি। পাঠশালায় (পাঠশালা দক্ষিণ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট) ফাউন্ডেশন কোর্স করলাম, ডিপ্লোমা শুরু করলাম। এমন সময় মনে হলো ফিন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ের চেয়ে আমি আলোকচিত্রে বেশি আগ্রহী। এমবিএ ছেড়ে দিলেও পাঠশালায় পড়াশোনা চালিয়ে গেছি।’

পাঠশালা থেকে ডিপ্লোমা শেষে জার্মানি যান আশফিকা। সেখানে হশুলে হ্যানোভার ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস অ্যান্ড আর্টসে আলোকচিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। এর মাঝে শান্তিনিকেতনে যান। সেখানে ফটোগ্রাফি গবেষণা নিয়ে কাজ করেন স্টুডিও গোপ্পোর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক অর্পণ মুখার্জি গবেষণা করছেন ১৯ শতকের ফটোগ্রাফি চর্চা নিয়ে। যখন ছবি প্রিন্ট করতে হতো হাতে। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। এমনকি এখনো আমার গবেষণা সমন্বয়ের কাজ ওনার সঙ্গেই করি।’

আশফিকার তোলা ছবি
আশফিকার তোলা ছবি

এবার আসা যাক আশফিকার কাজের ধরনে। সমসাময়িক বিষয় তুলে ধরার জন্য ৫০ থেকে ১০০ বছর আগের ছবি প্রিন্ট করার প্রক্রিয়া ব্যবহার করেন তিনি। রাসায়নিক ব্যবহার করে কাগজে হাতে প্রিন্ট করেন। ডিজিটাল ফরম্যাটে ছবি তুললেও নেগেটিভ তৈরি করে সেই পুরোনো প্রক্রিয়ায় প্রিন্ট করেন। মূলত পুরোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে নতুন বিষয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে চান আশফিকা রহমান। তিনি বলেন, ‘বলতে পারেন এটা আমার একধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আমি একটা কাজ করেছিলাম, যেখানে প্রিন্ট করতে হয় তরল সোনা দিয়ে। এটা রাজারা শুধু রাজকীয় পরিবারের জন্য করতেন। সংখ্যালঘুদের ছবি প্রিন্টে আমি একই প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছি। বিভেদ দূর করা ছিল উদ্দেশ্য। আবার পুরোনো ছবির জন্য পুরোনো উপকরণ ব্যবহার করি। একটা নান্দনিক মিল বলতে পারেন। পুরো কাজটা যেন একধরনের ছন্দে চলে। আমি আসলে নাচের মানুষ তো, আমি চাই যেন তাল-লয়গুলো মেলে।’

এখন কী নিয়ে কাজ করছেন? উত্তরে বললেন, ‘আমি তো সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করি, এখনো তা-ই করছি। আরেকটা কাজ করছি ইউরোপের নির্বাসিত শিল্পী বা সমাজকর্মীদের নিয়ে।’

সব শেষে এল জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাস প্রসঙ্গ। বললেন, জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাসের জন্য নির্বাচিত হওয়া আমার জন্য ভীষণ অনুপ্রেরণার। এটা একটা প্ল্যাটফর্ম। এতে একধরনের দায়িত্ব আসে। এরপর আমাকে এগিয়েই যেতে হবে, থামার সুযোগ নেই।’

তা তো বটেই। এখন তো তাঁর এগিয়ে যাওয়ারই সময়।