কমনওয়েলথের জনগণের সেবায় জীবন উৎসর্গ করবেন প্রিন্স হ্যারি

>
কমনওয়েলথ ইয়ুথ ফোরামে বক্তব্য রাখছেন প্রিন্স হ্যারি
কমনওয়েলথ ইয়ুথ ফোরামে বক্তব্য রাখছেন প্রিন্স হ্যারি

কমনওয়েলথের তরুণ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের পঞ্চম উত্তরসূরি প্রিন্স হ্যারি। সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর তরুণদের এক সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।

শুভসকাল, স্বাগত

একাদশ কমনওয়েলথ ইয়ুথ ফোরামের উদ্বোধন উপলক্ষে আজ (১৬ এপ্রিল) আপনাদের সঙ্গে এখানে এসে আমি খুবই রোমাঞ্চিত বোধ করছি। রানির কমনওয়েলথের তরুণ প্রতিনিধির দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার প্রথম বক্তৃতার শ্রোতা হিসেবেই ঘরভর্তি এই উজ্জ্বল তরুণদের পাওয়া আমার জন্য খুবই সম্মানজনক। এই নতুন ভূমিকায় কেমন করে সবচেয়ে তাৎপর্যবহ প্রভাব সৃষ্টি করা যায়, তা নিয়ে আমি যখন ভাবছিলাম, তখন আমার মনে হলো, কমনওয়েলথকে ঘিরে যা কিছু সুন্দর, তার অনুপ্রেরণার মূল উৎসের কাছেই হাত পাতি-স্বয়ং রানির বাণী।

আজ থেকে বহুদিন আগে, রানি তাঁর ২১ তম জন্মদিনে কেপটাউন থেকে বেতারে একটি অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতের দিকে নজর রেখে এবং অনড় দায়িত্ববোধ থেকে একটা অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জীবনের দৈর্ঘ্য বড় হোক কিংবা ছোট, তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করবেন কমনওয়েলথের জনগণের সেবায়।

আজ এখানে সমবেত আমরা সবাই কৃতজ্ঞতা বোধ করতে পারি এ কারণে যে রানি এখনো আমাদের পাশে আছেন। মহামান্য রানির প্রতিশ্রুত কমনওয়েলথ আজ অনেকগুলো জাতির এক বিশাল পরিবার। প্রায় ২৫০ কোটি মানুষের এক অভিন্ন যোগসূত্র এবং গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও শান্তির ধারক।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কমনওয়েলথের উন্নয়নে রানির অসামান্য সাফল্যের পেছনে কেবল সদস্য দেশগুলোর প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের দিকে তাঁর অবিচল মনোযোগই নয় বরং সেসব দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসাও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

সাতচল্লিশ সালের সেই বক্তব্যের সময় থেকেই তিনি জানতেন, যুব সমাজই পরিবর্তনের মূল কারিগর। তাঁর মতো তরুণদের নিয়ে কমনওয়েলথকে পৃথিবীতে আরও অবাধ, আরও সমৃদ্ধ, আরও সুখী এবং আরও প্রভাবশালী করে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথের দেশগুলোর ঘুরে দেখার সময় আমি বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করেছি, আজকের তরুণ প্রজন্ম অনেকটা আলাদা। আপনারা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। নিজেদের সম্প্রদায়, জাতি তথা বিশ্বজুড়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে আপনারা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করছেন।

আপনারা যত্নবান। আপনারা চান আপনাদের জাতিগুলো আরও পরিচ্ছন্ন হোক, আপনাদের এই বিশ্ব আরও সবুজ হোক। জাতি, ধর্ম ও সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আচরণ হোক সুন্দর ও সম্মানজনক, এটাই আপনাদের চাওয়া।

আপনারা আশাবাদী, আমরা আজ যেসব জটিল সমস্যার মুখোমুখি-জলবায়ু পরিবর্তন, অসাম্য, সংঘাত-এসবের কোনো কিছুই আপনাদের উৎসাহ দমাতে পারে না। এসব আপনাদের বরং আরও পরিশ্রমী হতে এবং পরিবর্তন আনতে অনুপ্রাণিত করে। কেবল আমাদের এই ২২টি দ্বীপরাষ্ট্রই নয়, গোটা কমনওয়েলথের তরুণ সমাজই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেবে। আপনারাই তো এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন রোজ। যেসব পরিবর্তনের স্বপ্ন আমরা দেখি, তার বাস্তবায়নে আমাদের কাজ করতে হবে আরও জোরেশোরে। পরিবর্তনের চাকাটা ঘুরিয়ে যেতে হবে পরম নিষ্ঠায়। কমনওয়েলথবাসীদের শতকরা ৬০ ভাগই ৩০ বছরের কম বয়সী। সংখ্যায় আপনারা ১৪০ কোটি; আপনারাই তো এই বিশ্বটাকে বদলে দিতে যাচ্ছেন।

কমনওয়েলথের দেশে দেশে আমি যে তরুণ বন্ধুদের দেখা পেয়েছি, তাঁরা বারবার আমাকে দেখিয়েছেন, এই প্রজন্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু উপলব্ধি করছে। তা হলো, কোনো চ্যালেঞ্জের যথার্থ মোকাবিলায় আপনাকে তার মূল কারণটাতেই হাত দিতে হবে, লক্ষণগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। আমার বাবা এটা বিশ্বাস করে এসেছেন বছরের পর বছর, অথচ এই সমাজ সমস্যাটির সঙ্গে এখনো লড়াই করে যাচ্ছে।

এটা আমি শিখেছি প্যাটরিস মাদুরাইয়ের মতো মানুষের কাছ থেকে। প্যাটরিসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়, দুই বছর আগে। গ্রামের দরিদ্র সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের ঘাটতি নিয়ে তাঁর উদ্বেগ আমি লক্ষ করেছি। তিনি বুঝতে পেরেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের অভাবই মানুষকে পিছিয়ে রাখে। এই অভাবের কারণে তারা পরীক্ষায় বসতে পারে না বা চাকরির জন্য আবেদন করতে পারে না। প্যাটরিস তাই ভাসমান কর্মশালা খুললেন, যেখান থেকে মানুষ জাতীয়তা নিবন্ধনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু করতে পারে। কোনো স্বল্পমেয়াদি সমাধানের পেছনে তিনি ছোটেননি, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বের করাই ছিল তাঁর অঙ্গীকার।

পরিবেশবিদ ওয়েন শিন শিয়া মানুষকে তাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করেছেন। তিনি জানতেন, গৃহস্থালি রান্নায় ব্যবহৃত পোড়া তেল ড্রেনে ঢেলে দেওয়ার প্রবণতা গোটা মালয়েশিয়াজুড়ে পানি সরবরাহব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি করে। তবে তিনি এটাও জানতেন যে মানুষকে কেবল এই খারাপ অভ্যাস বদলানোর কথা বললেই তাতে কোনো কাজ হবে না। সে জন্যই ভিন্ন কৌশল নিলেন তিনি। পোড়া তেলের বদলে বিনা টাকায় সাবান বিতরণ শুরু করলেন। এর ফলে মানুষের সেই পুরোনো ক্ষতিকর প্রবণতা বদলাতে শুরু করল। ব্যবহৃত ভোজ্যতেল পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ পরিবেশসম্মত পণ্য ও মোমবাতি তৈরি করে আবার সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের কাছেই বিক্রি করছেন। মানসিকতার পরিবর্তন এবং কোনো সমস্যা গোড়া থেকে সমাধানের এটি আরেকটি উদাহরণ।

আমি জানি, তরুণ সমাজের জন্য দূত হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমাকে আপনাদের সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে হবে। এখন এই বিশেষ ভূমিকায় আমার প্রথম বছরটির জন্য পরিকল্পনা তৈরি করছি। আশা আছে, তরুণ নেতাদের এক করে আলোচনায় বসব। কেমন করে কমনওয়েলথের মঞ্চকে আমরা সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে পারি এবং সর্বোচ্চ সুফল অর্জন করতে পারি-এসব নিয়ে কথা হবে।

এখানে এই যুক্তরাজ্যে এবং যেখানেই আমি ভ্রমণে যাব, আমার কাজ হবে আপনাদের কথা শোনা। আমার দায়িত্ব হবে চিন্তা-চেতনা, উদ্বেগ, ভাবনা ও প্রত্যাশার কথাগুলো যেন শোনা হয়, তা নিশ্চিত করা। আর আমার অঙ্গীকার হবে আপনাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে নেতৃত্বের আরও উন্নত মঞ্চ গড়ে তোলা, দেশে দেশে আপনাদের প্রাজ্ঞজনের সঙ্গে সংযোগ ও গঠনমূলক অংশীদারত্ব উন্নয়নে সহায়তা করা।

আমার এই নতুন ভূমিকায় আমার কাজ হবে মহামান্য রানি, আমার বাবা প্রিন্স অব ওয়েলস ও আমার ভাই উইলিয়ামকে সমর্থন জোগানো। তাঁরা সবাই জানেন, তরুণেরা হচ্ছেন আজকের সব চ্যালেঞ্জের জবাব। এ ছাড়া আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ যে আমি যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি, সেই মেগানও এই কাজে আমার সঙ্গে যোগ দেবে। সে এই ব্যাপারে খুবই আগ্রহী।

শেষ করার আগে প্রতিনিধি হিসেবে এই ভূমিকায় আমি আমার প্রথম পদক্ষেপটির কথা বলি। আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করেছি যে আগামী বছর থেকে কমনওয়েলথ বৃত্তির পরিসর আরও বাড়বে। যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ২০১৫ সালের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ১৫০টি নতুন বৃত্তি দেওয়া হবে। অ্যাসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ পরিচালিত এই পদ্ধতির মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের আরও বেশি তরুণ বন্ধুরা জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সুযোগ পাবেন। গর্বের সঙ্গে বলছি, কমনওয়েলথের প্রতি মহামান্য রানির অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই বৃত্তিগুলোর নাম হবে ‘দ্য কুইন এলিজাবেথ কমনওয়েলথ স্কলারশিপ’।

আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করছি। যে প্রজন্মের কাছ থেকে আমি অনুপ্রেরণা পাই প্রতিদিন, তাদের জন্য রানির দূত হওয়া আমার জন্য অনেক সম্মানের। আপনাদের জন্যই আমি আছি।

আপনাদের সম্মিলিত অর্জন দেখার জন্য আমার আর তর সইছে না!

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: জেরীন মারযান

সূত্র: রয়াল ডট ইউকে