দায়বদ্ধ এক স্থপতি

>বাংলাদেশের তরুণেরা মেলে ধরছেন নিজেদের। নানা ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভা দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তারুণ্যের জয়ধ্বনি। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করে ‘ছুটির দিনে’। এবারও ১৪২৫ নতুন বঙ্গাব্দে ‘ছুটির দিনে’ তুলে ধরছে ক্রীড়া, সংগীত, চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, আলোকচিত্র, সামাজিক ব্যবসা, স্থাপত্য-নানা ক্ষেত্রের উজ্জ্বল তরুণদের। অগ্রগামী এই তরুণদের জন্য আমাদের শুভকামনা। তাঁদেরই একজন স্থপতি ফারহানা রশীদ
ফারহানা রশীদ। ছবি: খালেদ সরকার
ফারহানা রশীদ। ছবি: খালেদ সরকার

ফারহানা রশীদের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশি দিনের নয়। তবু এই তরুণ স্থপতিকে আলাদা করে চিনতে খুব বেশি অসুবিধা হয়নি।

প্রথম দেখা হয় ২০১১-১২ সালের দিকে। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া থেকে একদল তরুণ শিক্ষার্থী এখানে এসেছিল ঢাকার স্থাপত্য দেখতে। তাদের পুরান ঢাকা ভালো করে দেখানোর জন্য একজন আমাকে ফারহানার নাম প্রস্তাব করল। বছরখানেক আগেই সে বুয়েটের (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপত্য বিভাগ থেকে পাস করেছে। কিছুদিন আরবান স্টাডি গ্রুপেও কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি পুরান ঢাকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে।

ফারহানা যখন এতজন আমেরিকান ছেলেমেয়েকে পুরান ঢাকা, বুড়িগঙ্গার দুই পাড় ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল, তখন দেখলাম শহরের সঙ্গে তার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। জায়গাগুলোর পেছনের গল্প যেমন ওর জানা, তেমনি সেগুলোর জন্য একটা অনুভবও কাজ করে ওর মধ্যে। একটা সম্ভাবনা ওর মধ্যে দেখেছিলাম।

পরে জানতে পারলাম, ফারহানা আমাদের পরিচিত আরেক মেধাবী তরুণ স্থপতির (মাসুদুল ইসলাম) স্ত্রী। ওর স্বামী পড়তে গেল হংকংয়ে, কিছুদিন পর ফারহানাও পড়তে চলে গেল সুইডেনে।

স্টকহোমের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে সাসটেইনেবল আরবান প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন বিষয়ে পড়াশোনা করল ফারহানা। ২০১৬ সালে দেশে ফিরে কিছুদিন কাজ করল বেঙ্গল ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্টসে।

এরপর ফারহানা ও তার স্বামী মিলে নিজেদের প্রতিষ্ঠান ‘ভূমিজ’ শুরু করল। ছোট ছোট জায়গায় কাজ করে শহরে কীভাবে বড় পরিবর্তন আনা যায়, সেটাই ফারহানা দেখতে চাইল।

এর মধ্যে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করল। প্রতিযোগিতার নাম ‘আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ’। কী করলে ঢাকা শহরের জীবনযাপন ব্যবস্থায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যাবে, তেমন আইডিয়াগুলো এখানে জমা দিতে বলা হলো। ফারহানাও তার একটা আইডিয়া জমা দিল।

ফারহানার আইডিয়াটা বেশ চমকপ্রদ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সবাই জানি, ঢাকা শহরের মতো একটা বড় শহরে পাবলিক টয়লেটগুলোর অবস্থা কী। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য ব্যবহার উপযোগী পাবলিক টয়লেট একেবারেই নেই। অথচ অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, ঢাকা শহরের রাস্তায় মেয়েদের, মায়েদের চলাচল বাড়ছে। আমরা জানি, দীর্ঘক্ষণ টয়লেট ব্যবহার করতে না পারার কারণে মেয়েদের স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

ফারহানার আইডিয়া ছিল, বর্তমানে যে অবকাঠামোগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, সেগুলোকে কীভাবে মেয়েদের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যায়।

প্রতিযোগিতায় প্রথম হলো ফারহানার প্রতিষ্ঠান ভূমিজ। ফারহানা ঢাকার একটি পাবলিক টয়লেটকে মেয়েদের জন্য উপযোগী করে তুলতে চাইল। সে বেছে নিল গাউছিয়াসংলগ্ন নূর ম্যানশনের একটি টয়লেটকে।

গাউছিয়ার ক্রেতাদের অধিকাংশই মেয়ে। এত নারীর আনাগোনা সেখানে, অথচ সেখানে তাঁদের জন্য কোনো টয়লেট সুবিধা ছিল না। ব্র্যাকের অর্থায়নে ভূমিজ সেখানকার টয়লেটটিকে নতুন করে তৈরি করেছে। ছয় মাস হলো সেখানকার মেয়েরা এখন এটি ব্যবহার করছেন।

ফারহানা এমন একটি মডেল নিয়ে কাজ করছে, যেখানে স্থানীয়ভাবেই এসব টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের খরচ উঠে আসবে। এ ধরনের কাজের কথা নানা সময় ভাবা হয়তো হয়েছে, কিন্তু করে দেখাল ফারহানা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এমন আরও অনেক পাবলিক টয়লেট করার পরিকল্পনা করছে সে। অনেক দূর এগিয়েও গেছে কাজে। আগামী বছরগুলোতে এসব করার পরিকল্পনা তার।

আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। আমরা স্থপতিরা নিয়মিত একটা সভা করি, মঙ্গলবারের সভা। সেখানে একবার ফারহানা একটা উপস্থাপনা দেখাল। রংপুর শহর নিয়ে সে কিছু কাজ করছিল। কীভাবে শহরের অনেক জায়গা নানাভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা বলেছিল। মোহাম্মদপুরে যখন ওরা থাকত, তখন একটা পরিত্যক্ত জায়গায় বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করে দিয়েছিল।

এ ব্যাপারগুলোই ফারহানাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। ছোট ছোট উদ্যোগ দিয়ে কীভাবে একটা পরিবেশের উন্নতি করা যায়, সেটা নিয়ে সে ভাবে।

আসলে একটা দেশ, একটা শহর গোছানোর কাজ করাই তো স্থপতিদের দায়িত্ব। শহর শুধু একটা অর্থনৈতিক সত্তা নয়। এর পরিবেশ যদি সুন্দর না থাকে, বাড়ির বাইরের রাস্তায় যদি হাঁটা না যায়, বাচ্চা বা বৃদ্ধদের কোথাও যাওয়ার যদি জায়গা না থাকে, তাহলে এই শহরের আর কী মানে হলো?

ভবিষ্যতের কথা যদি বলি, তাহলে ফারহানা রশীদের মতো আরও অনেক তরুণ স্থপতি আমাদের দরকার। যারা শুধু নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত থাকবে না, বরং সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে তারা তাদের কাজ দিয়ে নিবেদিত থাকবে। তাহলেই হয়তো ভবিষ্যতে আমরা একটা সুন্দর শহর, সুন্দর দেশ পেতে পারি।

লেখক: স্থপতি