এক জাদুকরী রাজকুমার

>বাংলাদেশের তরুণেরা মেলে ধরছেন নিজেদের। নানা ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভা দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তারুণ্যের জয়ধ্বনি। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করে ‘ছুটির দিনে’। এবারও ১৪২৫ নতুন বঙ্গাব্দে ‘ছুটির দিনে’ তুলে ধরছে ক্রীড়া, সংগীত, চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, আলোকচিত্র, সামাজিক ব্যবসা, স্থাপত্য-নানা ক্ষেত্রের উজ্জ্বল তরুণদের। অগ্রগামী এই তরুণদের জন্য আমাদের শুভকামনা। তাঁদেরই একজন সংগীতশিল্পী প্রীতম হাসান
প্রীতম হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ
প্রীতম হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ

-‘হ্যালো প্রীতম, ব্যস্ত নাকি’ (আমি)।

কানের রফাদফা করা চিৎকার দিয়ে প্রীতম উত্তর দেয়, ‘নাআআআ, বলোওওও, কেমন আছোওওও।’ দীর্ঘদিনের চেনাজানায় যতটুকু জানি তাতে বুঝলাম, বাবুমশাই এখন কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তিত আছেন। এমনটাই হয়। বেশি চিন্তামগ্ন সময়ে তার গলার স্বর বদলে যায়, চিৎকার দিয়ে কথা বলে কিংবা জোরে জোরে হাসে। এর মাত্রা চরম সীমায় পৌঁছালে গলা ফাটিয়ে গান করে আর ঘন ঘন লাফাতে থাকে। এমনই প্রাণচঞ্চল আর ভিন্ন স্বভাবী আমাদের তরুণ প্রিয় সংগীত পরিচালক ও শিল্পী প্রীতম হাসান।

গানের প্রতি ভালোবাসা থেকে গানের মানুষদেরও ভালোবাসি। কয়েক বছর আগে তেমনই এক গান-আড্ডাময় বিকেলে প্রীতমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। পান্থপথে সংগীত পরিচালক অদিতের স্টুডিওতে কর্মতৎপর চঞ্চল স্বভাবের প্রীতমকে দেখলাম। প্রথম সাক্ষাতের আসরেই হাস্যরসে ভরপুর একটা সময় পার করলাম আমরা। সেই থেকেই জানি প্রীতম হাসানকে।

প্রীতম একটা সংগীত অনুরাগী পরিবার থেকে এসেছে, তা জানতাম। বাবা প্রয়াত সংগীতশিল্পী খালিদ হাসান মিলু ও বড় ভাই প্রতীক হাসানের যোগ্য অনুসারী। তবে প্রথম দেখায় মনে হয়নি গান নিয়ে একজন তরুণ এতটা শৌখিন ও দক্ষ হতে পারে। সে যা-ই হোক, এ তো গেল প্রথম দিককার দিনগুলোর কথা। প্রীতমের পরবর্তী কাজগুলো আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে। আমার দেখা কম বয়সে গানের জগতে আসা অথচ গান বিষয়ে জানাশোনায় সমৃদ্ধ মানুষদের মধ্যে প্রীতম সেরা।

ব্যক্তিজীবনে প্রীতম অসাধারণ। খুব অল্প সময়ে এত এত জনপ্রিয়তা পেয়েও ‘ইগো’ নেই একদমই তার। প্রচণ্ড বিনয়ী, সদা শিখতে চায়, নতুন কিছু করতে চায়। অনুরোধে ‘না’ বলতে যেন জানেই না প্রীতম। তবে কর্মব্যস্ততায় সব কথাই হয়তো না রাখতে পারাটা মেনে নেওয়ার মতো স্বাভাবিক।

বেশ কদিন আগে প্রীতমের নতুন স্টুডিওতে যাওয়া হলো। দেখলাম, এত কাজের মাঝেও নিজ হাতে আতিথেয়তাটা বেশ খোশমেজাজেই করে যাচ্ছে। স্নেহভরা কণ্ঠে জানাল, এই ‘না’ না বলতে পারার দরুন প্রচুর কাজ হাতে নিয়ে বসে আছে। তবে সেখানে খামখেয়ালির টিকিটিও নজরে পড়ল না। একের পর এক কাজ সেরেই যাচ্ছে। তারুণ্যে ভরপুর বয়সে ভীষণ পরিশ্রমী ও পরিকল্পনা করে চলে প্রীতম হাসান।

প্রীতম হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ
প্রীতম হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ

সুপারহিট হওয়া তার সব গানে আমরা প্রীতমের সৃজনশীলতা দেখেছি। তাকে কখনো একই কাজ বারবার করতে দেখিনি। সব সময় নতুন কিছু করার চেষ্টায় থাকে। নতুন নতুন কাজের মাধ্যম, ধরন কিংবা বিষয় নিয়ে কাজ খোঁজে সে। তবে কোনো কাজেই কখনো একগুঁয়েমি করতে দেখিনি প্রীতমকে। নিজের দৌরাত্ম্য না বুঝেই ‘করতেই হবে’ মনোভাব রাখে না সে। নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ সামনে এলে সবদিক ভেবেই পা বাড়ায় প্রীতম। আমার দৃষ্টিতে একজন সফল মানুষের এ একটা বড় গুণ।

 প্রীতমের শখের একটা বড় অংশ হলো ভ্রমণ করা। নতুন জায়গা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য দেখে ঘুরে বেড়াতে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে। ‘ঘুরব-ফিরব-শিখব’ ধাঁচের মানুষ প্রীতম। প্রিয় খেলা ফুটবল। আর ফ্যাশনের প্রতি একটা দুর্বলতা আছে বলে মাঝে মাঝে মনে হয়। বিশেষত পোশাকের প্রতি। এ ছাড়া প্রীতমের চোখেমুখেই কেমন একটা অভিনেতার ছাপ দেখা যায়। প্রীতমের মুখের প্রতিটা ভাবই অনেকটা উন্নত অভিনয়। ভবিষ্যতে প্রীতমকে নাটক বা সিনেমায় অভিনয়শিল্পী হিসেবে দেখলে একটুও অবাক হব না। সেখানেও সে যে খুব সফল হবে, তা আমি নিশ্চিত।

বলতে খারাপই লাগে, আমাদের দেশের মিডিয়া শিল্পটা খুব বেশি ভরসা করার মতো নয়। আর সে জন্য অদূর ভবিষ্যৎ ভাবনাও ভাবে প্রীতম। সম্প্রতি দেশের একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক করতে শুরু করেছে সে। পড়াশোনার বিষয়ে ভীষণ মেধাবী প্রীতম। এত কাজের ভিড়েও তার চেষ্টা ভালো ফল করার। ভবিষ্যতের কোনো অনিশ্চয়তা কাটাতে সংগীতের পাশাপাশি বিকল্প একটা পথ তৈরি করে রাখতেই আবার একাডেমিক পড়াশোনা শুরু করা তার।

রূপকথার গল্পের এমন কোনো জাদুকরের কথা জানেন, যার মায়াবী মোহে সবাই আচ্ছন্ন থাকে। কিংবা এমন কোনো রাজকুমারের কথা যার সহজ-সরল অথচ দুঃসাহসিক বীর যে কিনা সবার মন জয় করতে জানে। বাস্তবে আমাদের প্রীতম হাসান এমনই একজন জাদুকর রাজকুমার।

লেখক: সংগীতশিল্পী, সাংবাদিক