শুভ্রামনি

>বাংলাদেশের তরুণেরা মেলে ধরছেন নিজেদের। নানা ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভা দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তারুণ্যের জয়ধ্বনি। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করে ‘ছুটির দিনে’। এবারও ১৪২৫ নতুন বঙ্গাব্দে ‘ছুটির দিনে’ তুলে ধরছে ক্রীড়া, সংগীত, চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, আলোকচিত্র, সামাজিক ব্যবসা, স্থাপত্য-নানা ক্ষেত্রের উজ্জ্বল তরুণদের। অগ্রগামী এই তরুণদের জন্য আমাদের শুভকামনা। তাঁদেরই একজন অভিনয়শিল্পী পরীমনি

স্বপ্নজাল চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার কাজ শেষ হলো ২০১৫ সালের শেষের দিকে। প্রি-প্রোডাকশন বা শুটিংয়ের আগের কাজ হলো। অপু চরিত্রের কাস্টিং খুব দ্রুত সেরে ফেললাম। অপুর চরিত্রে কাজ করা সোনাইকে (অভিনেতা ইয়াশ রোহান) আমি আগে থেকেই জানতাম। অভিনেতা দম্পতি নরেশ ভূঁইয়া আর শিল্পী সরকার অপুর মেজ ছেলে সে। নিষ্পাপ কান্তিমান তরুণ। গোল বাধল শুভ্রা চরিত্র নিয়ে। চরিত্রের জন্য একজন নারী দরকার। তাকে ঢাকায় খুঁজি, কলকাতায় খুঁজি—শুভ্রার দেখা মেলে না। অন্য চরিত্রগুলোর কাস্টিং মিলে গেল। শুভ্রা আর মেলে না। নিজের ওপর তখন একরকম ত্যক্ত-বিরক্ত। এমন এক সময় কেউ একজন বলল, ‘পরীমনিকে দেখো।’

পরীমনি। ছবি: কবির হোসেন
পরীমনি। ছবি: কবির হোসেন


আমি তাকে দেখতে গেলাম এফডিসিতে। দেখা হলো। দেখেই মনে হলো, এই তো শুভ্রা। পরিচয় হলো পরীমনির সঙ্গে। কথা হলো। শুরু হলো স্বপ্নজাল-এর কাজ, পরীমনির সঙ্গে কাজ।

স্বপ্নজাল-এ শুভ্রা যেন পাশের বাড়ির সুশ্রী মেয়েটি। একটুখানি নাচ জানে, তার চেয়ে বেশি গান জানে, প্রয়োজনে সংগ্রামী হয়ে ওঠে, অতিরিক্ত চাপে নেতিয়েও পড়ে। পূর্ণাঙ্গ একটি চরিত্র।

পরীমনির অভিনয়দক্ষতা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। অডিশন নেওয়ার পর মনে হলো, হয়ে যাবে। ক্যামেরার সামনে লুক টেস্টের পর আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। গ্রুমিং সেশনগুলোতে আমি ওর একটা দারুণ গুণ লক্ষ করলাম—ও খুব দ্রুত শিখতে পারে। আমার বিচারে এত দিন ওর কাছে নায়িকা ছিল একটা আইডিয়া, ক্যারেক্টার না। নায়িকা হিসেবেই ও অভিনয় করত। এখানে ওকে বলা হলো তুমি নায়িকা নও, তুমি শুভ্রা, শুভ্রার চরিত্র তোমাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।

শুটিং শুরু হলে দু-তিন দিনের মধ্যেই পরীমনি শুভ্রা হয়ে উঠতে শুরু করল। যত দিন গড়াল, সে তত শুভ্রার গভীর থেকে গভীরে নিজেকে আবিষ্কার করেছে। একজন অভিনয়শিল্পীর এই গুণ আমার বড় ভালো লাগে। ব্যক্তিগত জীবনে চঞ্চলমতী পরীমনি পর্দায় ধীরস্থির শুভ্রা, বিরহী শুভ্রা, সংগ্রামী শুভ্রা, অসহায় শুভ্রা হয়ে যায় নিমেষে। এ কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়। অভিনয় অনেক কঠিন কলা। অভিনয়শিল্পী নিজে যা নন, তা-ই তাঁকে হয়ে উঠতে হয়। এ এক সাধনার ব্যাপার।

আমি আমার পরিচালকের জায়গা থেকে বলব, পরীমনি সফল। স্বপ্নজাল মুক্তির পর দর্শক প্রতিক্রিয়ায় তা স্পষ্ট। ব্যক্তিজীবনে ওকে আমি যতটুকু দেখেছি, ও বন্ধুবৎসল, পরোপকারী, জেদি। ওকে বকা দিয়ে কোনো কাজ আদায় করা যায় না। কিন্তু ভালোবেসে জেদটাকে উসকে দিলে আর কথা নেই—ওর কাছে যে অভিনয়টা চাওয়া হবে, তা দেওয়ার জন্য ও শতভাগ চেষ্টা করবে। আর সৎ চেষ্টার ফল আসতে বাধ্য।

কলকাতার শুটিংয়ের কথা মনে পড়ছে। দেশে আমরা আমাদের মতো শুটিং করি। কিন্তু ভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিবেশে নতুন শিল্পী, নতুন টেকনিশিয়ানের সঙ্গে কাজ। কেমন অভিজ্ঞতা হয়, কীভাবে মানিয়ে নেব, কোনো ধারণা নেই। তার ওপর কলকাতার দৃশ্যগুলোর প্রায় ৯০ ভাগই শুভ্রার দৃশ্য। আমি তাকে বললাম, শুনেছি কলকাতার অভিনয়শিল্পীরা খুব পেশাদার। ওরা সময় মেনে চলে, যখন সেটে আসার কথা, ঠিক তখনই আসে। আমাদের দিক থেকে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে। তেমন কিছু হলে দেশের বদনাম হয়ে যাবে। তাই তোমাকে প্রতিদিন ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে এবং রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে টানা ১২ দিন।

সে আমার কথায় মিষ্টি করে হাসল এবং ঠিকঠাক সময়মতো গাধার খাটুনি খেটে শুটিংটা শেষ করল। অন্য শিল্পীদের ডে অফ ছিল, দেরিতে কল ছিল কিংবা অগ্রিম ছুটি ছিল। পরীমনির কোনো ফুরসত ছিল না। তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা আমাকে বিস্মিত করেছে। এ ছাড়া তার অভিযোজন-ক্ষমতা অসাধারণ। একজন অভিনয়শিল্পীর অভিযোজন-ক্ষমতা তাকে বহুদূর নিয়ে যায়। স্বপ্নজাল ইউনিটে ও যখন কাজ করতে যায়, একমাত্র মিশা সওদাগর ছাড়া বাকি সব শিল্পীই ছিল তার কাছে নতুন। কাজটাও তার পরিচিত ধারার নয়। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে কখনোই মনে হয়নি নতুন কারও সঙ্গে কাজ করছে। খুব চমৎকারভাবে সে ইউনিটের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সবশেষে বলব, বাংলা চলচ্চিত্র একজন তারুণ্যদীপ্ত গুণী অভিনয় শিল্পীর সাক্ষাৎ পেয়েছে। সে দিনে দিনে সুঅভিনয় দিয়ে বাংলা চলচিত্রকে ঋদ্ধ করবে।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা