স্বপ্ন যখন ভেঙে যায়

পরিবারের সুখের কথা ভেবে বিদেশে কাজ করার আশায় নিবন্ধন করেন নারীরা। ফাইল ছবি
পরিবারের সুখের কথা ভেবে বিদেশে কাজ করার আশায় নিবন্ধন করেন নারীরা। ফাইল ছবি

পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশবিভুঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সালমা বেগম। তাঁর সে স্বপ্ন ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। সৌদি আরবে যাওয়ার তিন মাসের মাথায় নিয়োগদাতা তাঁকে বিক্রি করে দেন অন্য একজনের কাছে। নতুন মালিকের অধীনে ১১ মাস কাজ করেন। তবে বেতন পাননি। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে প্রায় ২০ মাস সৌদি আরবে থেকে গত সপ্তাহে দেশে ফিরেছেন সালমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেতন পাইছি ৩ মাস। আর এজেন্সির কাছে ৪ মাসের বেতন পাই। বাকি মাসের বেতন মালিকেরা দেয় নাই। কিছু বললেই ওরা গালাগালি করত। সারা দিন কাজ করালেও ঠিকমতো খেতে দিত না।’

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গৃহ খাতে কর্মী নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীরা সৌদি আরবে যাওয়ার পর থেকেই বেতন নিয়ে বঞ্চনার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছেন। পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনার জন্য অচেনা ভূখণ্ডে গিয়ে তাঁদের অনেকেই ফিরে আসছেন স্বপ্নাহত হয়ে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন৷ যাঁদের বড় অংশ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার৷ গত এক সপ্তাহে এমন ৯৩ জন নারী দেশে ফিরেছেন। এর আগে এ বছরের জানুয়ারি মাসে পাঁচ দিনে দেশে ফেরেন ৩২৪ নারী। এই নারীদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাঁদের অনেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফ হোমে ছিলেন।

বাংলাদেশ মাসিক ৮০০ রিয়াল (তৎকালীন ১৬ হাজার ৮০০ টাকা) বেতনে গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে। এত কম বেতনে গৃহকর্মী পাঠানোর চুক্তি করায় এবং নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকায় একাধিকবার নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো।

বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের সঙ্গে নারী গৃহকর্মী নিয়ে চুক্তি সইয়ের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে গেছেন প্রায় দুই লাখ নারী। গত ১৬ মাসে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছেন। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৩৯ হাজার ৫৭৫ নারী ১৫টি দেশে কাজের জন্য গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে যাওয়া নারীর সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। এর বাইরে ওমান, জর্ডান, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা।

বিদেশ যাওয়ার পর কোন দেশে কত নারী নির্যাতনের শিকার, এর পুরোপুরি তথ্য বিএমইটির কাছে নেই। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতিত নারী শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন।

সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা বলছেন, নির্যাতনের শিকার হওয়া বা ফেরত আসা নারীদের সংখ্যা খুব নগণ্য। তবে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত ব্যক্তি এবং মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিদেশে কাজের জন্য গিয়ে একজন নারীও যদি নির্যাতনের শিকার হন, তার দায় নিতে হবে সরকারকে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নারী শ্রমিকদের নির্যাতনের বিষয়টি সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করলে হবে না। সৌদি আরবে নির্যাতিত নারী শ্রমিকদের নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা গেলে নারীদের সৌদি আরবে পাঠানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।

অনেক আশা নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন মিলি আকতার। সৌদি আরবে যাওয়ামাত্রই তাঁর ওপরে নির্যাতন শুরু হয়। তাঁর পিঠ, পায়ে দেওয়া হয় লোহার শিকের ছ্যাঁকা। তিনি গত শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রুমে টানা চার দিন বন্ধ করে রাখছে। খাইতে দেয় নাই। খালি মারছে। পরে পালায় যাই। পুলিশ ধরে জেলে দেয়। সেখান থেকে সেফ হোমে যাই।’ গত সপ্তাহে তিনি দেশে ফিরে এসেছেন।

সৌদি আরবে যাওয়া প্রায় ৫০ জন নারীকর্মীর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ২০১৬ সালে দূতাবাস ঢাকায় একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নারীকর্মীদের ঝুঁকিতে পড়ার বেশ কিছু কারণ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ-আতঙ্ক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বেতন না দেওয়া, অসুস্থ হলে চিকিৎসা না করা, দূতাবাসকে না জানিয়ে এক এজেন্সি থেকে অন্য এজেন্সিতে বিক্রি করে দেওয়া উল্লেখযোগ্য।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার বলেন, নির্যাতনের শিকার হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ চুক্তিতে রয়েছে। নারীরা দূতাবাসের সাহায্য না নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন। ফলে মালিকপক্ষ মামলা করে দেয়। ওই নারীকে দেশে ফেরত পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যায়।

অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী মনে করেন, নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা দিতে হলে সরকারকে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, সেফ হোমের সংখ্যা এবং দূতাবাসের জনবল বাড়াতে হবে। নারী শ্রমিকেরা যেন দূতাবাসে সহজে যোগাযোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

পরিবার-পরিজন ছেড়ে একজন নারী চাকরি করতে যান বুকে আশা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে। ভাবেন, রোজগার করে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের ভালো রাখবেন। কিন্তু ইদানীং যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে তাতে এই নারীদের স্বপ্ন যেন ভেঙে খান খান না হয়।