যেন খুবই নিষিদ্ধ কিছু

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

আমাদের কৈশোরে কারও ঋতুস্রাব হলে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলতে হতো, শরীর খারাপ হয়েছে। যার শরীর খারাপের কথা বলা হতো, সে লজ্জায়, সংকোচে, কুণ্ঠায় একেবারে কুঁকড়ে থাকত। যেন খুবই অন্যায় করে ফেলেছে সে। শেখানো হতো, ঋতুস্রাব খুবই গোপন আর লুকিয়ে রাখার একটি বিষয়। কিন্তু লুকানো কি আর থাকত? নাইন টেনে পড়ার সময় প্রায় প্রতিদিনই সহপাঠীদের কেউ না কেউ ইউনিফর্মের পেছনে রক্তের দাগ লাগিয়ে স্কুলের আয়া বা মাসিদের হাত ধরে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই বাড়ি চলে যেত। আমরা মেয়েরা ফিসফিস করতাম, ‘জানিস ওর না মাসিক হয়েছে।’

এই মাসিক ছিল এক মূর্তিমান যন্ত্রণার মতো, বিশেষ করে সেটা ম্যানেজ করা। মা তাঁর পুরোনো শাড়ি ছিঁড়ে বড় বড় রুমালের মতো টুকরা করে দিতেন, সেই টুকরা ভাঁজ করে মাসিকের রক্ত আটকানো হতো। এক সেট কাপড় ভিজে গেলে আরেক সেট কাপড় ব্যবহার করতে হতো। এ ছাড়া আছে ব্যবহৃত কাপড়টি পরিষ্কার করার ঝামেলা, সবার অগোচরে আলাদা সাবান দিয়ে ধুয়ে সেই কাপড় শুকাতে হতো। তাও তা প্রকাশ্যে কাপড় নাড়ার তারে শুকাতে দেওয়া যাবে না। শুকাতে হবে ঘরের ভেতরে আলনার পেছনে বা লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্ধকার কোনো জায়গায়।

ফলে মাসিকের বা পিরিয়ডের এই ৫-৭ দিন ছিল রীতিমতো একটি আতঙ্কের মতো। একটা অত্যাচারের মতো। বান্ধবীদের অনেকেই এই বিশেষ সময়টায় স্কুল কামাই দিত।

প্রথম স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একেবারে শেষ দিকে। তখন এত আনন্দ হয়েছিল, এই ভেবে যে এটি আবার ধুয়ে শুকানোর ঝামেলা নেই। ব্যবহার করে কাগজে মুড়িয়ে ফেলে দিলেই চলে। এখনকার যারা ঋতুস্রাবের প্রথম দিনটি থেকেই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে তারা কল্পনাও করতে পারবে না কী প্রচণ্ড মানসিক চাপ, বিরক্তি আর বিশ্রী অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। অনেক মেয়েই তখন সংক্রমণে ভুগত, অনেকেই চুলকানি বা অস্বস্তিতে পড়ত কিন্তু সেসব নিয়ে কারও কাছে কিছু বলতে পারত না।

সেই বিবেচনায় সময় পাল্টেছে অনেকটাই। কোনো কোনো পরিবার, এমনকি গণমাধ্যমে এখন এই বিষয় নিয়ে কথা হয় খোলামেলা। কিশোরীদের সুস্থতার জন্য এই বিশেষ সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং মানসিক সমর্থন যে কত জরুরি তাও আলোচনায় আসছে।

তবে এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক কিশোরীই হয়তো আধুনিক সুবিধাগুলো ব্যবহারের সুযোগ পায় না। এখনো প্রকাশ্যে ঋতুস্রাব নিয়ে কথা বলা বারণ। মা-বোনদের সঙ্গে ব্যাপারটি শেয়ার করা গেলেও বাবা বা ভাইদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলার স্বাচ্ছন্দ্য এখনো তৈরি হয়নি। এমনকি ওষুধের দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গেলে দোকানি সেটা কাগজে এমন করে মুড়ে দেন যেন কেউ বুঝতে না পারে কী কেনা হয়েছে। যেন এটা খুবই নিষিদ্ধ কোনো বস্তু। অথচ পিরিয়ড কত স্বাভাবিক একটা শরীরবৃত্তিক ব্যাপার, স্যানিটারি প্যাড কেনা একটা অ্যান্টিসেপটিকের শিশি বা এক পাতা প্যারাসিটামল কেনার মতোই সাধারণ একটি ঘটনা।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক