বাজরাকোনা থেকে কুইন্সপার্ক

ডলি বেগম। ছবি: সংগৃহীত
ডলি বেগম। ছবি: সংগৃহীত
>

১৯৯৯ সালের নভেম্বর। সিলেটের রাজনগর উপজেলার বাজরাকোনা গ্রামের রাজা মিয়া-জবা বেগম দম্পতি পাড়ি দিলেন কানাডার টরন্টো শহরে। সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া কন্যা ডলি ও পুত্র মহসিন।

অজানা দেশ, ভিন ভাষা, হিমশীতল পরিবেশে শুরু হয় তাঁদের নতুন সংগ্রাম। বছর পার না হতেই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলেন রাজা মিয়া। প্রবাসজীবনের শুরুটাই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল। সংসারে দেখা দিল টানাপোড়েন। হাল ছাড়েননি জবা বেগম; টেনে ধরলেন সংসারের লাগাম। ঠিক ১৯ বছর পর বাজরাকোনা গ্রাম থেকে আসা সেই কিশোরী ডলি রচনা করলেন নতুন ইতিহাস। ৮ জুন কানাডার অন্টারিও প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচনে স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হলেন ডলি বেগম। কানাডার রাজনীতিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কারও এমন সাফল্য এই প্রথম। কদিন আগে এক সন্ধ্যায় ডলি বেগমের সঙ্গে কথা হলো তাঁর বাড়িতে বসেই। 

কুইন্স পার্কে বাঙালির পদচিহ্ন

ডলি বেগম প্রথম বাংলাদেশি কানাডীয় নাগরিক, যে কিনা দেশটির প্রাদেশিক এমপি নির্বাচিত হয়ে উজ্জীবিত করলেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের। আগামী ১৬ জুলাই কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্ট কুইন্স পার্কে শপথ নিতে যাচ্ছেন ডলি বেগম।

রাজনীতিতে জড়ালেন কীভাবে? ডলি বেগম বললেন, ‘কখনো নির্বাচনে দাঁড়াব বলে তৈরি হইনি, ভাবনায় ছিল না। বলতে পারেন গত এক বছরের কাজের কারণে নির্বাচনে আসা। এ দেশে নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। আমার এসব কাজের অভিজ্ঞতা আর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক দলের স্কারবরো সাউথ আসনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জেনেছি এই এলাকার বাসিন্দাদের নানাবিধ সমস্যার কথা। জনগণের নীরব প্রতিবাদী মনোভাব আর আমার দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আমাকে উৎসাহিত করে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চাইতে।’

মানুষের পাশে দাঁড়ানো, আর স্থানীয়দের ন্যায্য দাবি পূরণের জন্য অবস্থান নেওয়ার প্রেরণা ডলি পেয়েছেন তাঁর প্রয়াত দাদা সোনা মিয়ার কাছ থেকে। তিনি মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর শেষযাত্রায় অসংখ্য মানুষ এসেছিলেন। ডলি বেগম সেই ভিডিও দেখেছিলেন। মানুষের মন জয় করে তাঁদের ভালোবাসা পাওয়াটাই যে আসল ব্যাপার, তা বুঝেছিলেন তিনি। তাই মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। ‘অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের ভিড়ে আমার মতো তরুণের জন্য স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট আসনে মনোনয়ন পাওয়া ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সহকর্মীরা।’ 

ডলি বেগম। ছবি: সংগৃহীত
ডলি বেগম। ছবি: সংগৃহীত


আশাজাগানিয়া ডলি

নির্বাচনীর প্রচারণায় ডলি বেগমের স্লোগান ছিল, ‘আমাকে নির্বাচিত করুন, আমি আপনাদের আশাহত করব না।’ তাঁকেও আশাহত করেননি ভোটাররা। আস্থা রেখেছেন তরুণ ডলির ওপর। ১ লাখ ১০ হাজার ২৮০ জন মানুষের এই এলাকায় ভোটার ছিলেন ৭০ হাজার। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই নড়েচড়ে ওঠেন কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশিরা। তাঁরা আশা করছিলেন ডলি জিতবেন, আর জিতলে তা হবে ইতিহাস। ১৯ হাজার ৭৫১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন ডলি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের প্রার্থীর চেয়ে ৬ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। 

নির্বাচনী প্রচারণায়
নির্বাচনী প্রচারণায়


নির্বাচনী প্রচারণার দিনগুলো

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই নিজ দলের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন ডলি। বললেন, ‘আমার পরিবারসহ বাঙালিরা প্রেরণা দিয়ে সাহস জুগিয়েছেন। সরাসরি ১০ হাজারের বেশি ভোটারের দরজায় আমরা কড়া নেড়েছি নির্বাচনী ইশতেহার জানাতে। প্রতিটি আবাসনে গিয়েই শুনেছি দীর্ঘদিন তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় এমপির যোগাযোগহীনতাসহ নানা বঞ্চনার কথা। তাঁদের বলেছি, রাজনীতিক হিসেবে নয়, নির্বাচনে হারি বা জিতি, আপনাদের মেয়ে হয়ে পাশে থাকব সব সময়।’

ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি ছুটে চলা, গণসংযোগ, নানা সংবাদমাধ্যমে কথা বলা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত তথ্য জানানো—অনেকটা ঝড়ের বেগে চলে আসে নির্বাচনের দিন। ডলি বেগমকে বিজয়ী করেন ভোটাররা। ‘তাঁদের ভালোবাসা নিয়ে জয় করতে চাই সামনের সব চ্যালেঞ্জ। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সপ্তাহে এক দিন নির্দিষ্ট অফিসে বসে মানুষের কথা শুনব। জনগণের প্রতিনিধি হয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে গিয়ে তাঁদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।’

ডলির বিজয়ে টরন্টোর বাঙালি অধ্যুষিত ডানফোর্থ এলাকায় বেরিয়েছে আনন্দ মিছিল। জিতলেন ডলি, সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ—এমনটাই বললেন প্রতিবেশী মমতাজ চৌধুরী। 

নির্বাচনী প্রচারণায়
নির্বাচনী প্রচারণায়


ডলির পড়াশোনা ও কাজ

টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে উন্নয়ন, প্রশাসন ও পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন ডলি। দুই পর্বেই তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলাদেশ। স্কারবরোর হেলথ কোয়ালিশন এবং ওয়ার্ডেন উড্স কমিউনিটি সেন্টারের ভাইস চেয়ার হিসেবে কাজ করছেন। অন্টারিও প্রাদেশিক ক্যাম্পেইন সমন্বয়ক হিসেবে সরব ছিলেন কিপ ‘হাইড্রো পাবলিক’ প্রচারাভিযানে। দীর্ঘদিন নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে নিজেকে তৈরি করেছেন ডলি। ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়নেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অন্টারিও ভলান্টিয়ার সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড, সিটি অব টরন্টো স্পটলাইট, সাউথ এশিয়ান ইয়ুথসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার। 

মা–বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে
মা–বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে


বাজরাকোনা টু হরিণাচং

ডলির জন্ম নানাবাড়ি হরিণাচং গ্রামে। দাদার ভাই রাজনগরের মনুমুখ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সুজন মিয়া এবং নানা আবদুল গাফ্ফার—দুজনের স্নেহধন্য ডলির শৈশব কেটেছে বাজরাকোনা আর হরিণাচং, এই দুই গ্রামে। মাত্র এক ঘণ্টার পথ। ডলি বললেন, ‘আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো এখনো চকচকে। বাজরাকোনা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু। স্কুলে আমার নাম ছিল শারমীন আক্তার সাথী। বাড়িতে ডাকা হতো ডলি। বিদেশে আসার সময় ডলি নামটাই পাসপোর্টে দিয়েছিলেন বাবা। মনে আছে দিদিমণির কথা। অপেক্ষা করতাম কখন বাজবে বেলা দেড়টা, মাঠে দেব দৌড়। সহপাঠী কলি আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল। আমার চেয়ে ১৬ দিনের বড়। ওর আকস্মিক মৃত্যুর খবর জানার পর অনেক দিন ঘুম হয়নি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন।’

মনুমুখ পিটি হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন ডলি। তবে বেশি দিন যাওয়া হয়নি। চলে আসেন কানাডায়। 

ডলি বেগমের প্রচারণায় আস্থা রেখেছেন স্থানীয় জনগণ
ডলি বেগমের প্রচারণায় আস্থা রেখেছেন স্থানীয় জনগণ


খাঁচার ভিতর অচিন পাখি

ডলি বেগমেরঅবসর কাটে গান শুনে, বই পড়ে। লালনের গান বেশি ভালো লাগে তাঁর। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ খুবই প্রিয়। ডলি বলেন, ‘শাহ আবদুল করিমের গানও শুনি। জানেন, বাংলা লেখা আমার জন্য কঠিন হয়ে গেলেও পড়তে আমি খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বাংলা পড়া আমি কখনো ভুলব না। সুযোগ পেলেই শাড়ি পরি, খুব আপন মনে হয়।’ পাশে বসা মা জবা বেগম জানালেন, পরিচিতজনেরা বলেন ডলির হাতের চা নাকি বিখ্যাত। ঘরের কাজেও মেয়েকে কাছে পান।

২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে ডলির বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্রায় ছয় বছর হাসপাতালে ছিলেন। পরিবাবের সেই কঠিন সময়ে কিশোরী ডলি মায়ের পাশে ছিলেন অটুট। ভাই মহসিন মিয়া ডলির চেয়ে আড়াই বছরের ছোট। সমাজকর্মে স্নাতক হয়ে তিনি এখন হোটেল ও আবাসন খাতে কাজ করছেন।

সামনে কি বাংলাদেশে যাচ্ছেন? ‘গেল বছর ঘুরে এলাম। সুযোগ পেলেই আমরা দেশে যাই।’ বললেন ডলি। জানালেন, ২০১১ সালে টানা সাত মাস ছিলেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণার কাজে। ‘মনু নদে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানো খুব মিস করি। আসলে আমি আমার রঙিন শৈশবকে খুঁজে ফিরি। আমার এই পুঁজিটা কখনো নষ্ট হতে দেব না।’