জীবনটা অনেক সুন্দর

জর্জ সন্ডারস যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক
জর্জ সন্ডারস যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক

সমাবর্তন বক্তৃতার একটা ঐতিহ্য তৈরি হয়ে গেছে: কিছু পুরোনো কথা বলা, নিজের জীবনের সেরা সময়গুলোর স্মৃতিচারণা করা, নিজের ভুলগুলো সম্পর্কে সবাইকে সাবধান করা এবং সম্ভাবনাময় তরুণদের উপদেশ দেওয়া। আমিও সে পথেই চলতে চাই।
আমি যখন সপ্তম গ্রেডে পড়ি, আমাদের সঙ্গে নতুন একজন মেয়ে পড়তে আসে। তার আসল নাম আমি বলতে চাই না, ধরে নিই তার নাম এলেন। এলেন ছিল অনেক লাজুক, ছোট ও চুপচাপ। সে এমন এক ফ্রেমে চশমা পরত, যেটা তখনকার দিনে বৃদ্ধ মহিলারাই শুধু ব্যবহার করতেন। সে প্রায়ই নার্ভাস থাকত এবং নিজের একগুছো চুল নিয়ে চিবোত। সে যখন আমাদের স্কুলে পড়তে এল এবং আমাদের প্রতিবেশী হলো। সে প্রায় সময়ই উপেক্ষিত থাকত। শুধু মাঝেমধ্যে তাকে উপহাস করা হতো এই বলে, ‘তোমার চুল কি অনেক সুস্বাদু?’ আমি খেয়াল করতাম, এই কথাগুলো তাকে খুব কষ্ট দিত। আমার এখনো মনে পড়ে, এ ধরনের কথার পরে সে চোখ নামিয়ে নিত, তার ঘাড় নিচু হয়ে আসত, যেন সে চারপাশের জগৎ থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইছে। একটু পরে সে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেত এবং তখন তার চুল থাকত তার মুখে। মাঝেমধ্যে আমি কল্পনা করতাম, বাসায় তার মা হয়তো তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ তোমার স্কুল কেমন হলো? নতুন কটা বন্ধু বানালে?’ সে চোখ নামিয়ে উত্তর দিত, অনেকগুলো।
মাঝেমধ্যে আমি তাকে তাদের বাগানে একলা ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। মনে হতো সে যেন বাগানের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। হঠাৎ একদিন আমরা আবিষ্কার করলাম, তারা সেখান থেকে চলে গেছে। কোনো ট্র্যাজেডি নেই, কোনো শেষ দেখা নেই। একদিন সে ছিল, পরদিন সে নেই। এখানেই গল্পের শেষ।
প্রশ্ন হলো, কেন আমি এটা নিয়ে আক্ষেপ করি? কেন ৪২ বছর পরেও আমি এই ঘটনা নিয়ে ভাবি। অন্যদের চেয়ে আমি মেয়েটার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতাম। কখনো আমি তাকে আঘাত দিয়ে কিছু বলিনি। বরং কখনো কখনো আমি তাকে অন্যদের কাছ থেকে আড়াল করতে চেয়েছি। কিন্তু, তারপরেও এটা আমাকে কষ্ট দেয়। যে কথাটি আমি বিশ্বাস করি, তা হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ, ক্ষমাশীল না হতে পারা। সেই সব মুহূর্তে ধীরে, চিন্তা করে কাজ করা যখন আমার সামনে আরেকজন মানুষ কষ্ট পাচ্ছিল।
আমরা ব্যাপারটিকে অন্যভাবেও দেখতে পারি; আমাদের জীবনে কোন মানুষগুলোর স্মৃতি সবচেয়ে প্রখর? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, সেই সব মানুষের, যাঁরা অন্যদের প্রতি ক্ষমাশীল ছিলেন। আমি তোমাদের বলতে চাই, জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে তোমরা ক্ষমাশীল হওয়াকে বেছে নিতে পারো। হতে পারে এটা অনেক সোজা অথবা অনেক কঠিন। কিন্তু উদ্দেশ্য হিসেবে খুব খারাপ নয়।
আমরা কীভাবে কম স্বার্থপর হতে পারি, সবার কথা ভাবতে পারি এবং সবার ভালোবাসা পেতে পারি?
খুবই ভালো প্রশ্ন। কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের হাতে সময় খুবই কম। আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই, পথ নিশ্চয়ই আছে। শিক্ষা এ ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের শিল্পের চর্চায় ব্যস্ত রাখাটা ভালো কাজ। নির্জনে কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ধ্যান করা, নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কোনো বন্ধুর সঙ্গে গল্প করা, আধ্যাত্মিকতার সন্ধান করা—এ সবকিছুই মানুষ হিসেবে আমাদের উন্নত করে। আমরা বুঝতে পারি, আমাদের আগে অসংখ্য জ্ঞানী মানুষ পৃথিবীতে এসেছেন এবং আমাদের জন্য অনেক প্রশ্নের উত্তর রেখে গেছেন।
একটা মজার জিনিস হলো, মানুষ কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একসময় অনেক ক্ষমাশীল হয়ে ওঠে। এটাই হয়তো মানুষের বৈশিষ্ট্য। আমরা যত বেড়ে উঠি, আমরা বুঝতে পারি যে স্বার্থপর হওয়াটা আসলে কতটা অর্থহীন, কতটা অযৌক্তিক। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাবনার পরিবর্তন হয় এবং মানুষকে ভালোবাসতে শিখি। যখন আমরা দেখি যে আমাদের বিপদে কেউ এগিয়ে এসেছে, আমাদের সাহায্য করছে, তখন আমরা বুঝতে পারি আমরা আসলে কারও কাছ থেকে পৃথক নই। আমরা যখন দেখি আমাদের প্রিয় মানুষ জীবন থেকে একে একে বিদায় নিচ্ছে, তখন আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে আমরাও একদিন বিদায় নেব। প্রায় সব মানুষই তার শেষ দিনগুলোয় অনেক বেশি ভালো আর উদার হয়ে ওঠে। এ জন্যই হয়তো কবি হেইডেন কেরুথ তাঁর শেষ বয়সে লেখা এক কবিতায় বলেছেন, ‘এখন শুধুই ভালোবাসা’।
আমি মন থেকে কামনা করি, তোমরা যত বড় হবে, ততই তোমাদের মধ্যে স্বার্থপরতা কমে আসবে এবং ভালোবাসা বাড়বে। তোমরা ধীরে ধীরে ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। যখন তোমাদের সন্তান হবে, তখন তোমরা ভালোবাসায় পুরোপুরি ভরে উঠবে। তোমরা তখন নিজেদের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তোমাদের সন্তানেরা ভালো থাকে। এটাই কারণ, যার জন্য তোমাদের মা-বাবা আজ এত খুশি। কারণ, তাঁদের অনেক দিনের পুরোনো একটা স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে, তোমরা জীবনের কঠিন আর গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ পার করে এসেছ। তোমরা এমন একটি জিনিস অর্জন করেছ, যেটা সামনের দিনগুলোয় তোমার জীবনকে সুন্দর করে তুলবে এবং মানুষ হিসেবে তোমাকে বড় করবে। তোমাদের সে জন্য শুভকামনা জানাই।
তারুণ্যের প্রথম দিনগুলোয় তোমরা হয়তো উদ্বিগ্ন ছিলে—কীভাবে জীবনে সফল হবে? কী করলে তোমাদের জীবনটাকে তোমরা সুন্দর করে সাজাতে পারবে? কিন্তু তোমরা কি কখনো ভালো করে জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা গুলোর অদ্ভুত একটা দিক খেয়াল করেছ? তোমরা হাইস্কুলে ভালো করো, যাতে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারো। এরপর তোমরা কলেজে ভালো করো, যাতে ভালো একটা চাকরি পাও। তোমরা এরপর চাকরিতে ভালো করতে চাও।
এসব জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু দিক, গোটা জীবনটা নয়। যদি, তুমি ক্ষমাশীল হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নাও, তাহলে একজন কর্মী ও স্বাপ্নিক হিসেবে নিজেকে আরও পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করবে। নিজের সেরাটা খুঁজে পেতে এটা তোমাকে অনেক সাহায্য করবে। তুমি তখন বুঝতে শিখবে যে সাফল্য একটা পাহাড়ের মতো, এটাতে তুমি যতই চড়বে, ততই তা বড় হবে। সাফল্যের চিন্তাই তোমার জীবনের সুন্দর সময়গুলোকে নিয়ে নেবে, এর মূল স্বাদটা তুমি উপভোগ করতে পারবে না।
তাই তোমাদের জন্য আমার উপদেশ। আমি ধরে নিচ্ছি, তোমাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ধীরে ধীরে আরও ক্ষমাশীল হওয়া, স্বার্থপরতা ছেড়ে দেওয়া আর ভালোবাসায় পূর্ণ হওয়া। এখন থেকেই সেটা শুরু হোক। আমাদের সবার মাঝেই স্বার্থপরতা রোগটা আছে। এর প্রতিষেধক খুঁজে বের করো এবং একজন সংবেদনশীল ভালো মানুষ হও।
এরপর জীবনের আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করো। ভ্রমণ করো, ধনী হও, বিখ্যাত হও, আবিষ্কার করো, নেতৃত্ব দাও, ভালোবাসো, সম্পদ অর্জন করো আবার তা খরচও করো, জঙ্গলের কোনো নদীতে খালি গায়ে সাঁতার কাটো। কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত ক্ষমাশীল হও। সেসব কাজ করো, যেগুলো তোমাকে ক্ষমাশীল হতে সাহায্য করবে। সেগুলো করো না, যেগুলো তোমাকে নিষ্ঠুর-স্বার্থপর হতে বাধ্য করবে। তোমার হূদয়ের উজ্জ্বল দিকটি অন্য সব মহাপুরুষের মতোই। যেসব কাজ তোমার এই উজ্জ্বলতাকে ঢেকে দেয়, সেগুলো বর্জন করো, হূদয়ের উষ্ণতা সবার মাঝে ছড়িয়ে দাও। এভাবে আজ থেকে ৮০ বছর পরে, যখন তোমার বয়স হবে ১০০ এবং আমার বয়স ১৩৪, তোমরা দেখবে যে ভালোবাসায় তোমরা গলা পর্যন্ত ডুবে আছো। আমি আশা করি, তখন তোমরা বলবে, জীবনটা অনেক সুন্দর।
২০১৩ সালের ব্যাচ, তোমাদের জন্য আবারও শুভকামনা। আমি প্রার্থনা করি, যাতে তোমরা আনন্দ, সৌভাগ্য ও একটি সুন্দর গ্রীষ্ম উপভোগ করতে পারো।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
পরিচিতি: জর্জ সন্ডারস জনপ্রিয় মার্কিন কথাসাহিত্যিক। তাঁর বিখ্যাত বইগুলো হলো: সিভিল ওয়ার ল্যান্ড ইন ব্যাড ডিক্লাইন, পেস্টোরালিয়া, দ্য ব্রিফ অ্যান্ড ফ্রাইটেনিং রেইন অব ফিল, ইন পারসুয়েশন নেশন, টেন্থ অব ডিসেম্বর। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি এই বক্তৃতা দেন।