বাংলা শিখতে বাংলাদেশে

কোযুয়ে কাতো: জাপানি এই শিক্ষার্থী বাংলা পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
কোযুয়ে কাতো: জাপানি এই শিক্ষার্থী বাংলা পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

সজাপানি-কন্যা কোযুয়ে কাতোর সঙ্গে কথা শুরু করলাম ‘গুড মর্নিং’ বলে। উত্তরে তিনি বললেন, ‘শুভ সকাল’! আমরা অবাক হলাম তাঁর সুন্দর বাংলা শুনে। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আমি বাংলা শিখতে বাংলাদেশে এসেছি। সুতরাং কথা হবে বাংলাতেই।’ তারপর বললেন, জাপানি ভাষায় ‘শুভ সকাল’ হচ্ছে ‘ওহাইয়ো’।

জাপানি-কন্যার এমন আহ্বানে ফেব্রুয়ারির এক মিষ্টি সকাল মুহূর্তেই উষ্ণ হয়ে উঠল। মনে হলো ‘আমার ভাইদের রক্তে রাঙান একুশে ফেব্রুয়ারি’ তাহলে বৃথা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বিস্তারিত কথোপকথন শুরু হয় কোযুয়ে কাতোর সঙ্গে। আমরা একটু একটু করে জানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে (আইএমএল) বাংলা শিখছেন জাপানি এই শিক্ষার্থী। এসেছেন জাপান-বাংলাদেশ ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’-এর অধীনে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে। এর আগে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে তাঁর বাংলা শেখার শুরু। কোযুয়ে কাতোর বর্ণনা মতে, ‘স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল একটা বিদেশি ভাষা শেখার। তারপর স্থানীয় স্কুলে ১২ ক্লাস পড়ার পর টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে পড়তে এসে বাংলা ভাষাটা খুব পছন্দ হয়ে গেল। এখানে অবশ্য ২৭টি বিদেশি ভাষা শেখানো হয়। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলা ভাষার ওপরেই উচ্চশিক্ষা নেব।’

অতএব, যথা সিদ্ধান্ত তথা বাস্তবায়ন। তিনি টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে বাংলা শেখার দুই বছরের কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলেন। সেটা ২০১২ সালের কথা। তিনিসহ মোট ১০ জন জাপানি শিক্ষার্থী ওই কোর্সে ভর্তি হলেন।

‘সেখানে এক বছর ধরে কিয়োকো নিওয়া ম্যাডাম ও মনজুরুল হক স্যারের তত্ত্বাবধানে বাংলা শেখার পর ঢাকায় এসেছি আরও উচ্চতর বাংলা শিখতে। এখানে আসার পুরো কৃতিত্ব অবশ্যই দিতে আমার এই দুই শিক্ষককে।’ বলছিলেন কোযুয়ে কাতো।
‘ও হ্যাঁ, ওই ১০ জনের মধ্যে আরও একজন বাংলা শিখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। তাঁর নাম মিকাকো ওমাতা।’ কথার শেষে যোগ করলেন তিনি।
কোযুয়ে কাতো এখন থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলে। ইতিমধ্যেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অনেক বাঙালি শিক্ষার্থীর সঙ্গে। বন্ধুদের মধ্যে নদী, লাবণী ও দিনা অন্যতম, যাঁরা সবাই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়েন।
বাঙালির অতিথিপরায়ণতা দেখে তিনি যারপরনাই মুগ্ধ! ইতিমধ্যে বাংলা খাবারও প্রিয় হয়ে উঠেছে কোযুয়ে কাতোর। বিশেষ করে আলুভর্তা। তবে ইলিশ মাছ খুবই সুস্বাদু বলে জানান তিনি। বাংলাদেশের এত ভালোর মধ্যে ‘ঢাকার যানজট’ খুবই ভোগায় তাঁকে। ইন্টারনেটও বেশ ধীরগতির বলে আক্ষেপ রয়েছে একটু। আর আক্ষেপ করলেন বাবা ইয়াসুহিরো কাতো ও মা মিচিকো কাতোর সান্নিধ্য পান না বলে। তিনি আরও জানালেন, তাঁর বাবা স্থানীয় পৌরসভার কর্মকর্তা ও মা বাঁশের খেলনা তৈরির ছোট ব্যবসা করেন।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে কোযুয়ে কাতো বাংলা শিখছেন আইএমএল-এর শিক্ষক রুপা চক্রবর্তী এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আয়েশা বেগমের কাছে।
কোযুয়ো কাতো সম্পর্কে রুপা চক্রবর্তী বলেন, ‘কোযুয়ে শুরুর দিকে অনেক শব্দ ঠিকভাবে বলতে পারত না। যেমন: ‘উনিশ’কে বলত ‘উনি’। এখন ধীরে ধীরে ও বিশুদ্ধ বাংলা বলতে শিখে গেছে।’
রুপা চক্রবর্তী আরও যোগ করেন, ‘ব্যক্তিমানুষ হিসেবে কোযুয়ে খুবই ভালো। ওর শেখার ব্যাপারে নিষ্ঠা আছে। সময়জ্ঞান খুবই ভালো। বাড়ির কাজ ঠিকভাবে করে আনে। সবচেয়ে বড় কথা, ও খুব পরিশ্রমী। ভবিষ্যতে বাংলা ভাষায় কোযুয়ে যথেষ্ট দক্ষ হবে বলে আমি আশাবাদী।’
কোযুয়ে কাতো নিজেও খুব আশাবাদী। তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করার। ‘ভবিষ্যতে অনুবাদের কাজ করতে চাই। এর মধ্যে অগ্রাধিকারে থাকবে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য।’ কথাগুলো যখন বলছিলেন তিনি তখন তাঁর চোখ জোড়ায় ভর করেছে অনেক বড় স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ঝিলিক অন্তরে মেখে আমরা বলি, ‘সায়োনারা’। তিনি সেই আগের মতো মিষ্টি হেসে বলেন, ‘বিদায়, আবার দেখা হবে। সায়োনারা।’