স্কুলে যেতে অনীহা?

মা রুনা খানের সঙ্গে স্কুলে যেতে বেশ মজাই পায় ছোট্ট রাজেশ্বরী। কিন্তু সবার বেলায় সবসময় এমন না-ও হতে পারে ছবি: কবির হোসেন
মা রুনা খানের সঙ্গে স্কুলে যেতে বেশ মজাই পায় ছোট্ট রাজেশ্বরী। কিন্তু সবার বেলায় সবসময় এমন না-ও হতে পারে ছবি: কবির হোসেন

ছোট শিশুরা নতুন পোশাক পরে দৌড়ঝাঁপ করে স্কুলে যাচ্ছে—এ দৃশ্যই তো বেশি চোখে পড়ে। তবে এর উল্টোও হতে পারে। স্কুলে যেতে আগ্রহ কম, ভীতি, কান্নাকাটি—এমনও দেখা যায় শিশুদের মধ্যে। এমন হলে স্বাভাবিকভাবেই উৎকণ্ঠায় পড়ে যান অভিভাবকেরা। তবে এর সমাধানও আছে।
স্কুলে যাওয়ার অনাগ্রহ শিশুরা দুভাবে প্রকাশ করে—সরাসরি ‘না’ করে বা কান্নাকাটি করে; অথবা নানাবিধ শারীরিক উপসর্গের (যেমন: পেটব্যথা, মাথাব্যথা, বমি করা ইত্যাদি) মাধ্যমে। এসব উপসর্গ যদি স্কুল বন্ধের দিনে না থাকে এবং এর তীব্রতা যদি শুধু স্কুলে যাওয়ার আগে বা আগের রাতে; স্কুলে থাকার সময়বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে আপনার সন্তানের কোনো কারণে স্কুলের প্রতি ভীতি বা অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব উপসর্গের কোনোটাই সে নিজ ইচ্ছায় করে না। স্কুলভীতি থেকে অবচেতনভাবে তৈরি হওয়া মানসিক চাপ এ রকম শারীরিক অসুস্থতার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।

স্কুল যখন অনাগ্রহের কারণ
সাধারণ একটা ধারণা হলো, পড়ালেখায় অনাগ্রহই বুঝি শিশুর স্কুলভীতির একমাত্র কারণ। কিন্তু শুনতে অবাক লাগলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্কুলের পরিবেশ, সহপাঠীদের আচরণ, এমনকি অভিভাবকের দৃষ্টিভঙ্গিও শিশুর স্কুলভীতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

স্কুলের পরিবেশ
 কঠোর পরিবেশ: পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ, প্রতিদিন পরীক্ষা, খেলাধুলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা কম থাকা ছাড়াও সামান্য ভুলে প্রচণ্ড তিরস্কার, কঠিন শাস্তি, সবার সামনে অপমান ইত্যাদি শিশুর সংবেদনশীল মনে স্কুলের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করতে পারে।
 স্কুলে যাওয়া-আসার সময় কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা (যেমন: ছিনতাই, দুর্ঘটনা, বখাটেদের উৎপাত ইত্যাদি) হওয়া বা দেখা।
 এ ছাড়া প্রিয় শিক্ষকের পরিবর্তন, নির্দিষ্ট শিক্ষকের প্রতি অহেতুক ভীতি ইত্যাদি শিশুর স্কুলভীতির কারণ হতে পারে।

সহপাঠীদের আচরণ
অনেক শিশুর মধ্যেই সহপাঠীদের শারীরিক বা মানসিকভাবে নাজেহাল করার প্রবণতা দেখা যায়। সাধারণত বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য (যেমন: উচ্চতা, শারীরিক গঠন, কথা বলার ধরন, গায়ের রং ইত্যাদি) নিয়ে খ্যাপানো হয়ে থাকে। এসব আচরণের পেছনে তেমন কোনো খারাপ উদ্দেশ্য না থাকলেও এগুলো শিশুদের নাজুক মনে সহপাঠী, তথা স্কুলের প্রতি অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

অভিভাবকের আচরণ
স্কুল থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বা স্কুল গেটেই পরীক্ষা, পড়াশোনা নিয়ে তিরস্কার, অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে নেতিবাচকভাবে তুলনা ইত্যাদি স্কুলভীতির কারণ হতে পারে। স্কুল ছুটির পর দীর্ঘ সময়ে অভিভাবকদের জন্য অপেক্ষাও শিশুর মনে তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। সেটা থেকেও স্কুলভীতি তৈরি হতে পারে।

মা রুনা খানের সঙ্গে স্কুলে যেতে বেশ মজাই পায় ছোট্ট রাজেশ্বরী। কিন্তু সবার বেলায় সবসময় এমন না-ও হতে পারে ছবি: কবির হোসেন
মা রুনা খানের সঙ্গে স্কুলে যেতে বেশ মজাই পায় ছোট্ট রাজেশ্বরী। কিন্তু সবার বেলায় সবসময় এমন না-ও হতে পারে ছবি: কবির হোসেন

স্কুলের প্রতি অনীহা হলে কী করবেন
 বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিন। স্কুলভীতির কারণে শারীরিক উপসর্গগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন। এ ক্ষেত্রে স্কুলে না যাওয়াকে প্রশ্রয় দেওয়া যেমন ভুল, তেমনি এ ক্ষেত্রে অহেতুক বকা দেওয়া, জোর করাও ঠিক নয়; বরং বাচ্চার স্কুলে অনাগ্রহের কারণ আন্তরিকভাবে তার কাছে জানতে চান। প্রয়োজনে শিক্ষকের সাহায্য নিন।
 স্কুলের মজার সময় নিয়ে কথা বলুন। স্কুল থেকে ফেরার পর প্রথমে বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা ইত্যাদি নিয়ে জিজ্ঞাসা করুন এবং বলতে দিন। প্রথমেই পরীক্ষা ও পড়াশোনা নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।
 সন্তান তার সহপাঠীদের হাতে নাজেহাল হলে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলুন। তবে কোনো অবস্থাতেই এ ক্ষেত্রে সরাসরি অভিযোগ করবেন না। নেতিবাচকভাবে সেই সহপাঠীকে তার অভিভাবকের সামনে তুলে ধরবেন না। সেই সঙ্গে আপনার সন্তানও যেন অন্য কাউকে হেয় না করে, সেই শিক্ষা দিন।
 দৌড়ঝাঁপ করে খেলাধুলা, স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশায় উৎসাহ দিন। এগুলো ভাষার দক্ষতা, সামাজিক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে সাহায্য করবে।

প্রথম স্কুলে যাওয়া
স্কুলে যাওয়ার দু-এক মাস আগে থেকেই শিশুকে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুক করুন। স্কুলে কী হয়, কারা থাকবে, কতক্ষণ সেখানে থাকতে হবে—এসব বিষয়ে তাকে আগে থেকে বলুন।
যদি স্কুলে গিয়ে শিশু আপনাকে একেবারেই না ছাড়তে চায়, সে ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে নিজেকে বিচ্যুত করুন। প্রথম কিছুদিন সম্ভব হলে ক্লাসের ভেতরে থাকুন। এরপর ক্লাসের বাইরে এমন জায়গায় থাকুন, যেখান থেকে সে আপনাকে দেখতে পায়। এরপর স্কুলে থাকুন, কিন্তু ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখা দেবেন না। তবে এ ক্ষেত্রে সন্তানের কাছে আপনার ছবি ও ব্যবহূত জিনিস রাখতে পারেন, যাতে সে আপনার উপস্থিতি বোধ করবে। এভাবে ধীরে ধীরে স্বাধীনভাবে স্কুলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা তৈরি করুন। প্রতিটি পর্যায় শিশুকে উৎসাহ দিতে ভুলবেন না। যেমন: ‘তুমি তো খুব সাহসী, মা ছাড়াই ক্লাস করলে’ ইত্যাদি।
বড়দের মতোই শিশুদের মধ্যে নানা উদ্বেগ, শঙ্কা, কষ্ট ও আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। সুতরাং, তাকে জানুন। তার আবেগ ও ভাবনা প্রকাশ করতে দিন। অহেতুক কোনো ভীতি থাকলে সে বিষয়ে আশ্বস্ত করুন। দিনের কত ঘণ্টা আপনি তার সঙ্গে কাটান, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং যে সময়টা আপনি তার সঙ্গে আছেন, সেটা কীভাবে কাটাচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সঠিক সাহচর্যই পারবে সব শঙ্কা দূর করে স্কুলের অপরিচিত পরিবেশ আপন করে নিতে এবং সেখানে থেকে ভালো কিছু গ্রহণ করতে।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা