নানা উপায়ে যৌন হয়রানি

বাসে চড়তে গেলেও নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন।  ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বাসে চড়তে গেলেও নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় শ্যামলী যাচ্ছিলেন সদ্য প্রভাষক পদে যোগ দেওয়া আসমা (ছদ্মনাম)। সান্ধ্য কোর্সে পড়ানো শেষ করে প্রায়ই বাসায় ফিরতে রাত হয় তাঁর। সে রাতে অটোরিকশার চালক বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে তাঁর সামনেই হস্তমৈথুন করা শুরু করেন চালক। গাড়ি থেকে নেমে কোনোমতে হেঁটে বাসায় পৌঁছেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আসমা।

মাস তিনেক আগে সন্ধ্যা সাতটার দিকে মুরাদনগরে একটি হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সায়মা (ছদ্মনাম)। অন্ধকার রাস্তায় হঠাৎ মাঝবয়সী এক লোক সামনে এসে প্যান্টের চেইন খুলে তাঁর পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে হাসতে লাগলেন। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিলেন সায়মা। লোকটি আরও জোরে হাসতে থাকেন। চিৎকার শুনে মানুষ জড়ো হয়ে সায়মাকেই বললেন, ‘যান যান, কিছু তো আর করে নাই আপনার সঙ্গে।’ ওই লোকগুলোর সহায়তায় পালিয়ে যান লোকটি। বহুদিন পরও সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেননি সায়মা।

অনেকের ধারণা, যৌন হয়রানি মানে শুধু জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। তবে ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করে রায় দেন হাইকোর্ট। সে সংজ্ঞা অনুযায়ী, অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি বা ইঙ্গিতে), পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা পেছন পেছন যাওয়া এবং যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা হলেও তা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। এমনকি চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ ও বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা, ব্ল্যাকমেল অথবা চরিত্র স্খলনের উদ্দেশ্যে স্থির বা চলমান চিত্র ধারণ করা, যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া, প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা এবং ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনে চেষ্টা করা হলেও তা যৌন হয়রানি হবে।

আসমা, সায়মাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আমলেই নেওয়া হচ্ছে না। হয়রানির মাত্রা কত দূর গেলে মানুষের মনে হবে নারীদের ওপর যথেষ্ট অত্যাচার হয়েছে—এটা এখন বড় প্রশ্ন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুবাদে প্রথমবারের মতো গণপরিবহনে ওঠেন খুশবু (ছদ্মনাম)। একদিন বাসে স্তনে জোরে চাপ অনুভব করেন তিনি। পেছনে ফিরে তাকিয়ে অপরাধীকে শনাক্ত করার আগেই বাস থেকে নেমে পড়েন কয়েকজন যাত্রী। এ ঘটনা কীভাবে মেনে নেবেন, খুশবু জানেন না।

মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বললেন, ১০ বছর আগে হাইকোর্ট চোখের দৃষ্টিতে কাউকে উত্ত্যক্ত করা থেকে ধর্ষণ পর্যন্ত যৌন হয়রানির খুঁটিনাটি উল্লেখ করে আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। নারীদের অভিযোগ গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এ আইনের ব্যাপক প্রচার হওয়া প্রয়োজন। সরকারের আইনি সহায়তা কেন্দ্রগুলোর প্রচার বাড়াতে হবে। এ ছাড়া এসব পরিস্থিতিতে নারীরা সহায়তার জন্য স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী বা এনজিওগুলোতেও যোগাযোগ করতে পারেন।