শমী-জেবার অর্জন

>

শমী হাসান চৌধুরী
শমী হাসান চৌধুরী

শতাধিক সমাজসেবী সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন প্রিন্সেস ডায়ানা, ব্রিটিশ যুবরাজ চার্লসের প্রথম স্ত্রী। তাঁর স্মরণে সমাজসেবায় যুক্ত তরুণদের ২০ বছর ধরে দেওয়া হয় ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড। প্রিন্সেস ডায়ানার দুই ছেলে উইলিয়াম ও হ্যারি সরাসরি এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। ১ জুলাই প্রিন্সেস ডায়ানার জন্মদিন উপলক্ষে ঘোষণা করা হয়েছে এ বছরের পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। যাঁদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের দুই তরুণী—শমী হাসান চৌধুরী ও জেবা খান। মেসেঞ্জারে দুজনের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন মো. সাইফুল্লাহ 

পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেন শমী। ছবি: সংগৃহীত
পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেন শমী। ছবি: সংগৃহীত

শমীর সীমানা নেই 

পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা (ওয়াশ) বিষয়ক সচেতনতা তৈরির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন শমী হাসান চৌধুরী। কীভাবে পানি বিশুদ্ধ করতে হয়, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব কী, মাসিকসংক্রান্ত কুসংস্কার কোনগুলো, ৭ বছর ধরে এমন আরও নানা সচেতনতার কথা তিনি পৌঁছে দিচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে। অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটি নামে একটি সেবামূলক সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। 

শমীর সঙ্গে আলাপের শুরুতে যে প্রশ্নটা অবধারিতভাবেই করতে হয়, তা হলো ‘কোথায় আছেন এখন?’ 

সম্প্রতি অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করেছেন ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া থেকে। নানা রকম কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে প্রতিনিয়তই তাঁকে ছুটতে হয় এ দেশ থেকে ও দেশ। শমীর ফেসবুক প্রোফাইল দেখলে মনে হয়, ২৪ বছর বয়সী মেয়েটির বুঝি কোনো ‘সীমানা’ নেই। কমনওয়েলথ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এশীয় প্রতিনিধি হিসেবে তরুণদের কথাগুলো নীতিনির্ধারকদের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া তাঁর কাজ। সেই সূত্রে গত বছর কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষামন্ত্রীদের এক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ফিজিতে। এর আগে রানি এলিজাবেথের ৯২তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে লন্ডনে গেছেন। ২০১৮ সালে কমনওয়েলথ অবজারভার গ্রুপের সঙ্গে গিয়েছেন পাকিস্তানে, দেশটির নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসোর্স নেটওয়ার্ক ২০১৮ সম্মেলন ও কানাডার ভার্জিনিয়ায় লিডারসটুডে গ্লোবাল ইয়ুথ সার্ভিস সামিটে অংশ নিয়েছেন একজন অন্যতম বক্তা হিসেবে। এ মাসের শুরুতেও তাঁর সংগঠন অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটির গল্প বলতে গিয়েছিলেন থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। সব ভ্রমণেই তাঁর সঙ্গে থাকে বাংলাদেশের পতাকা। 

শমী বলছিলেন, ‘সামনের মাসে রুয়ান্ডা যাচ্ছি “কমনওয়েলথ ইয়ুথ ফোরাম ২০২০”–এর প্রস্তুতি নিতে। তরুণদের যে বিশেষ দলটি আগামী বছর ইয়ুথ ফোরামে কাজ করবে, তাঁদের একজন হিসেবে আমি নির্বাচিত হয়েছি। সেপ্টেম্বরে যাব লন্ডনে, কমনওয়েলথ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং মিটিংয়ে অংশ নিতে।’ 

 ২০১৪ সালে শমীর মা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর আগেও সমাজ সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু মাকে হারানোর পর পুরোদমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। কখনো ময়মনসিংহের পতিতাপল্লি, কখনো হরিজনপল্লি ঘুরে তিনি স্বাস্থ্য সুরক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। সমাজসেবা কার্যক্রমের পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন নানা পুরস্কার। এত সবের মধ্যে ‘ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড’ কেন বিশেষ কিছু? বললেন, ‘সমাজকর্মীদের জন্য প্রিন্সেস ডায়ানা সব সময়ই বড় অনুপ্রেরণার নাম। পৃথিবীতে পরিবর্তন আনার জন্য তিনি সব সময় তারুণ্যের শক্তির ওপর আস্থা রেখেছিলেন। সে জন্যই এই পুরস্কারটা আমার কাছে আলাদা গুরুত্ব রাখে।’ 

শমী জানালেন, বিশ্বের ২৩টি দেশে তরুণেরা অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটির সঙ্গে কাজ করছেন। বাংলাদেশে এখন কী কী নিয়ে কাজ করছেন? জানতে চাইলে বললেন, ‘টয়লেটের সমস্যার সমাধানের জন্য একটা সামাজিক ব্যবসার মডেল তৈরি করছি আমরা। তরুণদের সক্ষমতা তৈরির একটা প্রকল্পও শিগগিরই শুরু করব।’ 

পিরিয়ড ইনক নামে একটি সেবামূলক সংস্থায় কাজ করেন জেবা
পিরিয়ড ইনক নামে একটি সেবামূলক সংস্থায় কাজ করেন জেবা

জেবার জয়গান 

বছর পাঁচেক আগের কথা। জেবা খান তখন ঢাকার সানিডেইল স্কুলে পড়েন। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বিশ্বনাথপুরে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় সেখানকার একটি মেয়ের সঙ্গে। গল্প করতে করতে জেবা জানতে পারেন, মাসিকের সময় মেয়েটি স্কুলে যায় না, তাকে বিছানায় ঘুমাতে দেওয়া হয় না, এমনকি গ্রামের পুকুরে গোসল করাও ‘নিষিদ্ধ’ হয়ে যায়। শুনে খুব বিস্মিত হন জেবা। সেই বিস্ময় আরও বাড়ে, যখন ২০১৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডায় পাড়ি দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন, কানাডাতেও মাসিক নিয়ে নানা রকম কুসংস্কার আছে। জেবা বুঝতে পারেন, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পিরিয়ড ইনক নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি এই সমস্যা রোধে কাজ করতে শুরু করেন। সেই কাজের পুরস্কার হিসেবেই ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন জেবা খান। এখন তিনি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় (ইউবিসি) ‘নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান ফিজিওলজি’ বিষয়ে শেষ বর্ষে পড়ছেন। পাশাপাশি কাজ করছেন গবেষক হিসেবে। 

জেবা খান
জেবা খান

জেবা বলেন, ‘বিশ্বে আমার কাজের যে একটা গুরুত্ব আছে, তার একটা স্বীকৃতি হলো এই ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড। অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের জন্য আরও নানা রকম সুযোগ করে দেয় ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন। অনেক রকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, যা আমাকে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু শিখতে, আরও উন্নত হতে সাহায্য করবে।’ পিরিয়ড ইনক একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা নাদিয়া ওকোমাতোর সঙ্গে যোগাযোগ করে কানাডায় এর একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন জেবা। বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে তাঁর সংস্থা, মাসিকবিষয়ক সচেতনতা তৈরির জন্য আয়োজন করে বিভিন্ন আলোচনা সভা, কর্মশালা ইত্যাদি। 

বাংলাদেশেও কি আপনারা কাজ করছেন? খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিলেন জেবা। ‘হ্যাঁ! বাংলাদেশে আমরা একটা দল তৈরি করছি। যেসব তরুণ বা অলাভজনক সংস্থা মাসিকবিষয়ক সচেতনতায় কাজ করছে, আমরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি। বাংলাদেশে আমরা কাজটা একটু ভিন্নভাবে করতে চাই। আমরা ঠিক করেছি, একেবারে স্কুলপর্যায় থেকে শুরু করব। স্কুলের মেয়েদের জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করব। কেউ যদি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তাঁকে স্বাগত।’ 

জানিয়ে রাখি, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (ফাইন্যান্স) হিসেবে কাজ করেছেন জেবা। ভিনদেশে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরতে নানা রকম অনুষ্ঠান আয়োজন করে এই সংগঠন। বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও গবেষণার প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ আছে। জেবার দুটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে দুটি প্রকাশনায়। স্নাতক শেষ করে তিনি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বা গণস্বাস্থ্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর করতে চান। এ ছাড়া আরও বড় করতে চান পিরিয়ড ইনকের পরিসর।