আমরা শেখার আনন্দ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ: অরুণ কুমার বসাক

১১ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে বক্তব্য দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তব্য দিচ্ছেন অরুণ কুমার বসাক। ছবি: পিয়ারু আর্কাইভ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তব্য দিচ্ছেন অরুণ কুমার বসাক। ছবি: পিয়ারু আর্কাইভ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উপাচার্য মহোদয় যখন প্রথম সমাবর্তনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন, আমি বিস্মিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে আমি এই সম্মানের যোগ্য কি না। তবে মহামান্য আচার্যের সম্মুখে আমার সারা জীবনের আবেগ প্রকাশ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে আমি বিনম্রচিত্তে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। আমি আজ আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হতে পেরে শিহরিত বোধ করছি। আমি তাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।

কর্মজীবনের শুরুতে আমি ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক আহমদ হোসেন। আমার মাস্টার্স থিসিসসংশ্লিষ্ট গবেষণার ফলাফল ১৯৬৪ সালে পিকিং আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে পরিবেশন করেছিলেন। কাজটি তৎকালীন প্রখ্যাত জাপানি বিজ্ঞানী সৌচি সাকাতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করে, যা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স ক্রনিক্যাল–এ উল্লিখিত হয়েছিল এবং তৎকালীন জাতীয় পত্রিকাগুলোতে শীর্ষ খবর হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি ওই গবেষণাকাজটির সহলেখক হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন যাওয়ার প্রাক্কালে আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। পাকিস্তান আমলে প্রতিবছর বৃত্তি পেয়েও বিদেশ যেতে পারিনি। আমার জীবন সূর্যের শুরুলগ্নে প্রতিকূলতা আমার মনকে বিষাদে ঢেকে দিলেও শিক্ষকতার দায়িত্বে আমি কোনো অবহেলা করিনি। বরং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আমি প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা উন্নয়নে সারা দিন কাজ করেছি। 

বাংলাদেশ বর্তমানে একই সঙ্গে সমস্যা ও সম্ভাবনার দেশ। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত থাকে সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী গর্ভধারিণী মা, জনগণ-নির্দেশক দেশমাতৃকা এবং মানুষের আবেগ ধারণকারী মাতৃভাষার মর্যাদার মাধ্যমে। সমস্যার দেশ এ কারণে যে আমরা ত্রিরূপী ‘মা’–এর সম্ভ্রম রক্ষার্থে ব্যর্থ হচ্ছি। শিক্ষিত-অশিক্ষিতের গুণগত মানের পার্থক্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া দেশে চলছে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবং এর ধারক ও বাহক শিক্ষিত ব্যক্তিরা। অশিক্ষিত জনগণকে এর মাশুল দিতে হচ্ছে এবং তারা নিষ্পেষিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমরা ‘জাহেলিয়াতের’ যুগে ফিরে যাচ্ছি।

 সংকট ও সম্ভাবনা

শিক্ষাঙ্গনে আমাদের সংকট, আমরা শিক্ষকেরা জ্ঞানদান করছি কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারছি না। এর কারণসমূহ: ১. শিক্ষার্থীরা অতি দুর্বল প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষায়তনে প্রবেশ করছে। ২. আমরা শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘শেখার আনন্দ’ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ৩. দীর্ঘকাল যাবৎ ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ অবহেলিত হচ্ছে সর্বস্তরে (এতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে বিজ্ঞানশিক্ষা পাচ্ছে না এবং তাদের বিষয়গত কনসেপ্ট পরিষ্কার হওয়ার সুযোগ হচ্ছে না।) ৪. পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অভিভাবকদের চাপ প্রয়োগ করার কারণে শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থের মাধ্যমে প্রচুর পরিশ্রম করে, কিন্তু পড়াশোনাকে নিজের অনুভূতিতে অনুবাদ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ৫. দীর্ঘকাল যাবৎ সর্বস্তরে দুর্বল শিক্ষকদের নিয়োগ হয়েছে (অদক্ষ শিক্ষকেরা নেতৃত্ব
রক্ষার জন্য তাঁর চেয়ে অদক্ষ শিক্ষককে পছন্দ করেন)। ৬. পরীক্ষা পদ্ধতি
সঠিক হচ্ছে না এবং ৭. শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিয়োগ পদ্ধতি যুগোপযোগী হচ্ছে না। যাঁরা ভালো, তাঁরাও নানা কারণে নিষ্ঠাবান হতে পারছেন না। 

বাংলাদেশ সম্ভাবনার দেশ পাঁচটি কারণে: ১. এর ভৌগোলিক অবস্থান। দক্ষিণে সমুদ্র থাকায় আমরা পণ্য বিপণনে স্বাধীন। ভারতের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চল এবং ভুটান পণ্য ট্রানজিটে আমাদের ওপর নির্ভরশীল। ২. ২০০৬ সালে বঙ্গোপসাগরে সাবমেরিন-কমিউনিকেশন-কেব্‌ল সংযোগ বাংলাদেশকে বিশ্বের যেকোনো অতি শক্তিশালী কম্পিউটার ও তথ্যভান্ডার হাতের মুঠোতে এনে দিয়েছে। আইসিটির প্রভাবে বাংলাদেশে আমাদের জীবনযাত্রার মান, গড় আয়ু এবং খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বেড়েছে। ৩. শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি, যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রয়াত শিক্ষক অধ্যাপক উইলিয়াম বারচামের ১৯৭৬ সালের এক উক্তি, ‘উন্নত দেশের অর্থ-সাহায্য তোমাদের দেশকে পঙ্গু করে রেখেছে। তোমরা যদি এই সাহায্য না নিতে, তাহলে তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে।’ আজ আমি গর্ব অনুভব করছি, আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
৪. সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সূচকে বেশি উন্নতির ২০টি সেরা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ স্থান পেয়েছে।
৫. মানবতার কারণে বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘে জোরালো বক্তব্য রাখতে সমর্থ হচ্ছে। আমাদের আশা সঞ্চারিত হয়েছে। 

আমাদের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশের সম্ভাবনার গতি ব্যাহত হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতির অপপ্রয়োগের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ইউএস ডলার ডিজিটাল হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশে একটি সমস্যা পরীক্ষার ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’–এর রেশ এখনো চলছে। এসবের কারণ ‘লোভ’ নামক শয়তানের প্রভাবে ‘মূল্যবোধের’ ঘাটতির কারণে আমাদের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর ধারণা, অর্থ সম্মানের এবং আরাম-আয়েশ আনন্দ পাওয়ার মাপকাঠি। এরই প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল ব্যবস্থাদির অপব্যবহার চলেছে নির্বিবাদে। কম পরিশ্রমে লোভকে চরিতার্থ করতে আমরা শিক্ষকেরা ও অভিভাবকেরা মিথ্যা কথা বলি এবং ছলচাতুরীর আশ্রয় নিই। আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকে। আমাদের সন্তানেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে চালিত হয়। 

আমাদের কী করণীয়

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের মেধা উন্নত বিশ্বের ছেলেমেয়েদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমাদের দেশে অশিক্ষিত এবং স্বল্পশিক্ষিত কারিগর দল মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য উন্নত মানের জাহাজ তৈরি করছে। প্রাথমিক ধাপ থেকেই আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের অসংযত জীবনধারা, অপ্রতুল প্রশিক্ষণ পরিবেশ ও দুর্বল শিক্ষক আমাদের ছেলেমেয়েদের সাধারণভাবে দুর্বল করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অনেক পড়াশোনা করেও জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থতা বোধ করছে। তাদের সাধারণ প্রশ্ন, কী করলে সফল হতে পারবে তারা? উত্তরে আমি বলব:
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার বিষয়বস্তু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীর নিজের (সমগ্র বিশ্বে একই নিয়ম)। এর কারণ শিক্ষার্থীর দুর্বলতায় বিভিন্নতা থাকে। মনে মনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিকূলতা ও বাধা অতিক্রম করার জন্য পরিশ্রম, বিচার-বুদ্ধি, নিষ্ঠা ও সাহস প্রয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২. শিক্ষকেরা তাঁদের সাধ্যমতো শিক্ষার্থীকে পরামর্শ দেবেন। শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অক্ষমতা শিক্ষকের জন্য মোটেই লজ্জাকর নয়। ৩. সব সময় মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকের বা আলোচকের বক্তব্য শুনতে হবে। ৪. পড়া কখনোই না বুঝে মুখস্থ করা নয়। প্রতিটি শব্দ, বাক্য এবং অনুচ্ছেদের অর্থ বুঝতে হবে। 

বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ করতে আমি বিনীত নিবেদন রাখছি। ১. বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতিতে পরীক্ষার ফলাফল শুধু মুখস্থশক্তির পরিচায়ক, শিক্ষার্থীর মেধা এবং সৃজনশীলতার নির্দেশক নয়। এই পরীক্ষাপদ্ধতিকে অর্থবহ করতে পরীক্ষার দিনগুলো ষাটের দশকের ন্যায় বিরামহীন করতে হবে (এসএসসি পরীক্ষার আগে) বাল্যকালের স্কুল পরীক্ষা থেকেই, যাতে শিক্ষার্থী সহজেই অভ্যস্ত হতে পারে। ২. দেশের সব কর্মকাণ্ডে শিক্ষিত মানবশক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সরবরাহ করে। অতএব, দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক অপরিহার্য। প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের প্রথম প্রবেশদ্বার। সে কারণে প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ–প্রক্রিয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এতে শক্তিশালী নির্বাচনী বোর্ড থাকা বাঞ্ছনীয়। ৩. বর্তমানে যেহেতু পরীক্ষার রেজাল্ট শিক্ষার্থীর মেধা ও জ্ঞানের পরিচায়ক নয়, তাৎক্ষণিক ২০ মিনিটের হস্তলিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এতে শিক্ষক নির্বাচনে স্বচ্ছতা বজায় থাকবে এবং কোয়ালিটি পঠন-পাঠনের জন্য ভালো শিক্ষক নির্বাচন নিশ্চিত হবে। ৪. কোয়ালিটি পঠন-পাঠনের প্রয়োজনে যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে, এ জন্য আমরা জার্মানির গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য ছিল: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্যানটিনগুলোর প্রতিটি কক্ষে দেয়ালজুড়ে ব্ল্যাকবোর্ড রাখা এবং যতক্ষণ খদ্দের থাকে, ততক্ষণ ক্যানটিন খোলা রাখা। ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহারকারীর নির্দেশ ছাড়া বোর্ড পরিষ্কার করা নিষেধ ছিল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেত, ব্ল্যাকবোর্ডে রাখা অসম্পূর্ণ সমস্যার পূর্ণ সমাধান হয়ে আছে এক অচেনা আগন্তুক কর্তৃক, যার মাধ্যমে একটা বড় আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। 

দেশের স্থায়ী উন্নতির জন্য বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ অপরিহার্য। কবি ও সাহিত্যিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আনন্দ সুধা পরিবেশন করে মানুষের হৃদয়কে হরণ করেন। বিজ্ঞানী যন্ত্রের মাধ্যমে অর্জিত ফলাফল দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণ এবং অন্তর্নিহিত সত্যকে উদ্‌ঘাটন করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘গণিতের ছন্দ সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে নিহিত আছে।’ অন্যদিকে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার ভাষা বুঝতে তাঁর সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করতে হবে বিজ্ঞানের আলোকে।’ একমাত্র ‘যুগান্তকারী আবিষ্কার’ দেশের সম্মান ও শক্তি
এনে দিতে পারে, যেমনটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, চীন, ইসরায়েল, কোরিয়া ও ভারতে। তবেই উন্নত দেশ আমাদের গণ্য করবে। তখনই অর্জিত হবে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’। 

 (সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)