কিশোরেরাও বাবা হচ্ছে

সন্তান কোলে কিশোর বাবা
সন্তান কোলে কিশোর বাবা

আকাশের (ছদ্মনাম) এইচএসসি প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। শেষবারের মতো পুরোনো পড়াগুলোতে চোখ বোলানো আর কিছু নতুন করে পড়া হচ্ছে। কিন্তু মনে দারুণ উত্তেজনা। তার স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আকাশের মায়ের চিৎকার, ‘তোর ছেলে হয়েছে। আজান দেওয়ার ব্যবস্থা কর।’
ঘটনাটি ঘটে ২০১১ সালে পাবনা জেলার আটঘড়িয়া উপজেলায়। বাবা হওয়ার সময় আকাশের বয়স ছিল ১৭ বছর। এখন সে সম্মান প্রথম বর্ষে পড়ছে আর তার সন্তানের বয়স দুই বছর। এসএসসি পরীক্ষার পরে সহপাঠিনীকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল আকাশ। শুধু আকাশ নয়, দেশে অনেক ছেলেই কিশোর বয়সে সন্তানের বাবা হচ্ছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা এর অন্তর্ভুক্ত। সে হিসাবে দেশে মোট কিশোরের সংখ্যা এক কোটি ৪২ লাখ। শুধু কিশোরীরাই যে মা হচ্ছে এমনটি নয়, কিশোররাও বাবা হচ্ছে। যদিও কৈশোর পিতৃত্বের হার কৈশোর মাতৃত্বের তুলনায় অনেক কম। তবে গ্রামে বিশেষ করে শহরের বস্তিতে কিশোর পিতৃত্বের হার উল্লেখযোগ্য। রাজধানীর বছিলা, মোহাম্মদপুর ও রায়েরবাজার বস্তিতে এমন অনেক বাবাকে পাওয়া গেছে, যাদের বয়স এখনো ২০ বছর হয়নি। তাদের বেশির ভাগই পোশাক কারখানার শ্রমিক, নয়তো গাড়ির হেলপার। মোহাম্মদপুর বস্তিতে সদ্য বাবা হয়েছে এ রকম একজন কিশোর রিটন (ছদ্মনাম)। কম বয়সে ছেলেকে কেন বিয়ে করিয়েছেন জানতে চাইলে তাঁর মা বলেন, ‘এইডা হইল কলিযুগ। যুবক পোলা আবিয়াত (অবিবাহিত) রাহন ঠিক না।’ আর রিটন মুচকি হেসে বলে, ‘এমনিই করছি। চিন্তাভাবনা করি নাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নেহাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, কৈশোর পিতৃত্বের মূল কারণ বাল্যবিবাহ। অভিভাবকেরা সচেতন হলে ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই বাল্যবিবাহ ঠেকানো সম্ভব। বাল্যবিবাহ হলে ছেলে এবং মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। একসময় তারা পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
একজন স্বামী বা পিতার কর্তব্য কী, কিশোর বয়সের একটি ছেলে তা যেমন জানে না, তেমনি নিরাপদ শারীরিক মিলন সম্পর্কেও জ্ঞাত নয়। তারা বেশির ভাগ সময় কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে না, যা কৈশোর পিতৃত্বের অন্যতম প্রধান কারণ।
সম্প্রতি সেন্টার ফর ম্যান অ্যান্ড ম্যাসকিউলিনিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামে অধিকাংশ সময়ই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় না। এমনকি বেশির ভাগ শিশুরই জন্ম হয় পিতা-মাতার কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়া। জরিপটি রংপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের পাঁচ ইউনিয়নের ৮০টি গ্রামে পরিচালিত হয়।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ছেলেদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। বেশির ভাগ গরিব বাবা-মা ছেলেকে বিয়ে করানোর মাধ্যমে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে চান। মোটা অঙ্কের যৌতুক নিয়ে তাঁরা ছেলের বিয়ে দেন।
এ ছাড়া যারা ঠিকমতো পড়াশোনা বা কাজকর্ম করে না অর্থাৎ বখে যায়, বাবা-মা তাদের বিয়ে দিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চান। রায়েরবাজার বস্তির এ রকম এক কিশোর পিতার বাবা বলেন, ‘পোলায় কাম-কাইজ করে না। আজেবাজে পোলাপাইনগো লগে মিশে। বিয়ে দিছি, পোলাপাইন হইছে, অহন ঠিক হইয়া যাইব।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৈশোর পিতৃত্বের ফলে ছেলেদের শারীরিক তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু সাংসারিক দায়িত্ববোধ, সন্তানকে প্রতিপালনের জন্য যে মানসিক ও আর্থিক অবস্থা থাকা দরকার, তা একটি কিশোরের থাকে না। প্রতিটি জিনিসের জন্য অভিভাবকের ওপর নির্ভরশীল থাকে, যাতে অনেক সময় তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। এ থেকে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, বর্তমানে বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ সামাজিক অবস্থা এবং প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার। তবে দারিদ্র্য আর যথাযথ শিক্ষার অভাব তো আছেই।
বস্তির অভিভাবকেরা একই মত পোষণ করে বলেন, মুঠোফোন ও কেব্ল টেলিভিশনের সহজলভ্যতা বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ। তাঁদের মতে, এসবের প্রভাবে কিশোর-কিশোরীরা অল্প বয়সে যৌনসম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ ছাড়া গরিব পরিবারে পারিবারিক পরিচর্যা ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবও এর কারণ বলে মনে করেন তাঁরা। কৈশোর পিতৃত্বের ঘটনা শুধু গ্রাম, বস্তি বা কম শিক্ষিত পরিবারে নয়, সমাজের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত পরিবারেও ঘটছে। এ রকম উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান সাগর। তার বয়স ১৮ বছর। কিছুদিন আগে ওর সন্তানের জন্ম হয়। সাগর রাজধানীর একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়ত। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় ২০১০ সালে ওরই সহপাঠিনীকে বিয়ে করে। এরপর সাগর আর পড়ালেখা করেনি, বাবার ব্যবসা দেখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান খান কৈশোর পিতৃত্বকে বাল্যবিবাহের ফল উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, কৈশোর মাতৃত্ব নিয়ে অনেক কাজ হলেও এ বিষয়টি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। কৈশোর পিতৃত্ব নিয়ে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আইনানুসারে, ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেদের বিয়ে দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বাল্যবিবাহ হচ্ছেই। এ ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করেন কাজিরা। জন্মনিবন্ধন সনদ দেখে বিয়ে নিবন্ধন করার নির্দেশ থাকলেও বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে যেমন, সনদে বয়স বাড়িয়ে বা ভুল বয়স লিখে নিবন্ধন করা হয়। এ ছাড়া নোটারি পাবলিক করে অভিভাবকের হলফনামা দিয়েও বিয়ে হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের শিশু অধিকার কমিটির চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘কৈশোর পিতৃত্ব নিয়ে আমরা আলাদাভাবে কাজ না করলেও দেশের বিভিন্ন জেলা ও বস্তিতে বাল্যবিবাহ নিরোধে মানবাধিকার কমিশন থেকে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো হয়। সেখানে কিশোরদের বাল্যবিবাহ বা কৈশোর পিতৃত্বের কুফল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
একজন কিশোর যখন নিজে বাবা হয়, তখন সে স্বাবলম্বী থাকে না। সে নিজের খাবারের ব্যবস্থা করতে না পারলে সন্তানের খাবার কিনবে কীভাবে? আমরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বন্ধে চেষ্টা চালাচ্ছি এবং এটা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এ বিষয়ে ধারণা দিচ্ছি।’ বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য যে শাস্তির বিধান রয়েছে তা যুগোপযোগী নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কমিশন থেকে বাল্যবিবাহের শাস্তি কঠোর করার একটি খসড়া তৈরি করছি, যা সরকারকে বাল্যবিবাহ তথা কৈশোর পিতৃত্বের হার কমাতে সাহায্য করবে।’