ফুটবল আমার ধ্যানজ্ঞান : লিওনেল মেসি

লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার আজেন্টিনার লিওনেল মেসি। জন্ম আর্জেন্টিনায়, ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন। বিশ্বসেরার স্বীকৃতিস্বরূপ মেসি চারবার ফিফা ব্যালেন ডি’অর সম্মাননা লাভ করেন।
তখন আমি বেশ ছোট। জন্মদিনের এক উপহার পেয়ে আমি চমকে যাই। সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। আমার এক আত্মীয় আমার হাতে ভিন্ন এক জীবন উপহার দেয়—এক নতুন ফুটবল। তিন কিংবা চার বছর বয়সে পাওয়া সেই উপহারের জন্য আজ আমি এখানে। সেই উপহার আমার মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে বড়দিন কিংবা জন্মদিন সব সময়ই উপহার হিসেবে আমার চাওয়া ছিল ফুটবল।
খুব সাধারণ এক ফুটবলপাগল পরিবারে ছিল আমার বেড়ে ওঠা। আমার বাবা-চাচাদেরও ছিল ফুটবল নিয়ে ভীষণ মাতামাতি। বাবা তো এক ফুটবল ক্লাবের কোচের দায়িত্ব পালন করতেন। প্রতিদিন নিয়ম করে স্কুলে যেতাম। সেখান থেকে ফিরেই মুখে কিছু একটা পুরে রাস্তায় ফুটবল খেলতে ছুটতাম। আমি সৌভাগ্যবান আমার সাধারণ পরিবারের জন্য। বাবার দিনভর পরিশ্রমই ছিল আমাদের একমাত্র রুজি। তিন ভাইয়ের জন্য ছিল বাবা-মায়ের সব আদর।
ছোটবেলায় আমি বেশির ভাগ সময়ই রাস্তায় ফুটবল খেলতাম। বাড়ির বাইরে যেখানেই সুযোগ পেতাম, সেখানেই খেলতাম। সত্যি বলতে কি, পাঁচ বছর বয়স থেকে ফুটবল আমার বন্ধু। পাড়ার বড় ভাইয়েরা রাস্তার ফুটবল ম্যাচে আমাকে নিতে চাইত না। আমার কাছ থেকে যখন বল নিতে পারত না, তখন তারা আমাকে দুষ্টুমি করে মারধর করতে চাইত। রাস্তার ওপর আমার ফুটবল খেলা নিয়ে আমার ভাই ভীষণ দুশ্চিন্তা করতেন।
রোজিওতে আমার জন্ম। সেই এলাকার ছোট ফুটবল ক্লাব গ্র্যান্ডোলিতে আমাদের পুরো পরিবারের সবাই বয়স অনুসারে সেই ক্লাবে খেলতাম। মা–ই থাকত শুধু খেলার বাইরে। আমরা প্রতি রোববার সারা দিন ক্লাবের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতাম। মা-দাদিও ছিলেন সেই ক্লাবের পাড় সমর্থক। বাবা তখন ক্লাবে কোচিং করাতেন, তিনিই আমার প্রথম কোচ। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করতাম।
সেই রাস্তা, সেই স্মৃতি, সেই সময়—সব আমার বদলে যায় খুব ছোট থাকতেই। স্পেনের বার্সেলোনায় আসার পরেই আমার সব পাল্টে যায়। ফুটবল খেলার বন্ধু, স্কুলের শিক্ষক-সহপাঠী, পরিবার এবং নিজের দেশ ছেড়ে মাত্র ১৩ বছর বয়সে এক মহাসাগর দূরে চলে আসি। এটা ছিল আমার জন্য ভিন্নমাত্রার অভিজ্ঞতা। একদিকে বার্সেলোনা থাকার নতুন অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে ছিল বাড়ি থেকে দূরে থাকার কষ্ট। প্রথম প্রথম অনেক মন খারাপ হতো। একা একা লাগত। কান্নাকাটি করতাম অনেক সময়। নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিতাম। ধীরে ধীরে আমি নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করি। আমার স্বপ্ন ছিল বার্সেলোনার মূল দলে ফুটবল খেলা। আমার জীবনের সবকিছু শিখেছি আমি বার্সেলোনাতে এসে। এখানেই আমি বড় হই, লেখাপড়াও এখানকার স্কুলে।
কিশোর বয়স থেকেই ফুটবল আমার ধ্যান-জ্ঞান। আমি ছোটবেলায় যেভাবে খেলতাম, এখনো সেভাবে খেলি। আমার খেলার ঢং একই রকম। আমি নিজের মতো খেলে যাই। বার্সেলোনাতে খেলে আমি ফুটবল নিয়ে অনেক কৌশল শিখতে পেরেছি।
কিশোর বয়সে প্রথমদিকে খেলার সময় ফুটবল কোচ ফ্যাবিও কাপেলো আমাকে ‘ছোট শয়তান’ তকমা দিয়েছিলেন। আমার জন্য সেটা ছিল খুবই আনন্দের। তিনি ফুটবল কোচ, তাঁর কাছ থেকে এত ছোট বয়সে প্রশংসা পাওয়া নিশ্চয়ই দারুণ ব্যাপার।
আমি ব্যক্তিগত সম্মাননা কিংবা নিজে বেশি গোল করতে আগ্রহী নই। আমি আমার দলের জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কারটাই আনতে চাই। আমি পৃথিবীর সেরা ফুটবলার হওয়ার চেয়ে একজন ভালো মানুষ হতেই বেশি আগ্রহী। কারণ, সবশেষে আমি যখন অবসরে যাব, তখন প্রত্যাশা থাকবে সবাই যেন আমাকে বিনয়ী হিসেবেই চেনে। আমি গোল করতে পছন্দ করি কিন্তু বন্ধুত্ব করতেও আগ্রহী বেশি। দলের ফুটবলাররা আমার বন্ধু। তাঁদের ছাড়া আমি তো আসলে শূন্য।
আমি হারতে ভীষণ অপছন্দ করি। সেটা বাস্তব জীবনেও। দরিদ্রতা আমাকে রাগায়। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, যেখানে দারিদ্র্যই বাস্তবতা। সেখানে অনেক শিশু আছে, যাদের বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে হয়। অন্য কিছু করার উপায় নাই বলে অনেক কম বয়সে কাজে করতে হয়। আমি বার্সেলোনাতে একটু ভালো পরিবেশে থাকার সুযোগ পেয়েছি। বাবার সঙ্গে থাকার সুযোগ পাই। কিন্তু বাস্তবতা আসলেই ভিন্ন। অনেক বাবা হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে তাঁদের সন্তানকে বড় করতে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
তথ্যসূত্র: এল পাই্যজ (২০১২) এবং ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে (২০১৩) দেওয়া মেসির সাক্ষাৎকার।
মেসি লেখাটি লিখেছেন জাহিদ হোসাইন খান