চট্টগ্রামের ছেলে ফরাসি বিপ্লবে

১৭৭৩ সাল। চট্টগ্রাম উপকূলে ইংরেজ দাস-ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়ল ১১ বছরের জামর। তারপর? চট্টগ্রামের এ ছেলেটি কীভাবে ফরাসি বিপ্লবের লড়াকু যোদ্ধা হয়ে উঠল?

জামরের প্রতিকৃতি; ছবিটি অতিরঞ্জিত, সম্ভবত কল্পিত; ফ্রান্সের ল্যুভর জাদুঘরে সংরক্ষিত এ ছবির শিল্পী মারি–ভিক্তোয়ার লোমোয়ান, ১৭৮৫
জামরের প্রতিকৃতি; ছবিটি অতিরঞ্জিত, সম্ভবত কল্পিত; ফ্রান্সের ল্যুভর জাদুঘরে সংরক্ষিত এ ছবির শিল্পী মারি–ভিক্তোয়ার লোমোয়ান, ১৭৮৫

ফরাসি বিপ্লব এনেছিল বিশ্বমানবের মুক্তির বার্তা। কিন্তু দুনিয়া পাল্টে দেওয়া সে বিপ্লবে যে অংশ নিয়েছিল এ দেশেরই এক ছেলে, তা কে জানত? অন্তর্জালে চাটগাঁর কৃতী সন্তানদের তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ পাওয়া গিয়েছিল জামর নামে সে যোদ্ধার নাম। কৌতূহলী অনুসন্ধানে আস্তে আস্তে হাতে আসতে থাকে আরও লেখা: ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ­-এ অভিজিত গুপ্তের ‘চাইল্ড ফ্রম চিটাগাং’, দ্য হিন্দুতে সরোজা সুন্দরারাজনের ‘ফর লিবার্টি অ্যান্ড ফ্রেটারনিটি’, আনন্দবাজার পত্রিকায় অভিমন্যু সারথির ‘বাঙালি এক বিপ্লবী দাসের কথা’। বহু তথ্য পাই ক্রিস্টোফার এল মিলারের বই দ্য ফ্রেঞ্চ অ্যাটলান্টিক ট্রায়াঙ্গল: লিটারেচার অ্যান্ড কালচার অব স্লেভ ট্রেড থেকে। জানতে পারি, জামরের ছবি আছে প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরে; ফ্রান্সে আছে তাঁকে নিয়ে বিচিত্র প্রকাশনা। একটি বই সেখান থেকে একদিন হাতে এসেও পৌঁছে যায়। খুলে যায় ইতিহাসের অজানা এক অধ্যায়।

মাদাম দ্যু বারি
মাদাম দ্যু বারি

১৭৭৩ সাল। চট্টগ্রামের উপকূলে হানা দিচ্ছে ইংরেজ দাস-ব্যবসায়ীরা। একটি দলের হাতে ধরা পড়ল ১১ বছরের জামর। জাহাজে তাকে পাচার করা হলো মাদাগাস্কারে। সেখান থেকে ফ্রান্স। পূর্ববাংলার এই বালকটিকে কিনে নিলেন ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই। কয়েক জোড়া পশুপাখিসহ তাকে তুলে দিলেন প্রিয় রক্ষিতা কাউন্টেস দ্যু বারির (১৭৪৩-১৭৯৩) হাতে।
জামর ঠিক বাংলা নাম নয়। উপনিবেশের দুঃসহ গোলকধাঁধা পেরিয়ে আদি কোন নামটি যে জামর হলো, কে জানে? জমির কি?
মাদাম বারি জামরকে ভেবেছিলেন আফ্রিকান। কৃষ্ণকায় এ বালকটিকে তিনি পুত্রস্নেহ দিয়েছিলেন। সাজিয়েছিলেন রেশম আর মসলিনে। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দিয়ে সম্রাটের উপাধি যুক্ত করে নাম রেখেছিলেন লুই-বেনোয়া জামর। দিয়েছিলেন শিক্ষা-দীক্ষাও।
দাস হলেও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন জামর। ধ্রুপদি ফরাসি সাহিত্য ও দর্শন পড়তে পড়তে একদিন তাঁর হাতে এল জাঁ জাক রুশোর বই। প্রবল এক ঝাঁকুনিতে রুশো তাঁকে জাগিয়ে দিলেন। ভেতরে বুনে দিলেন বিদ্রোহের বীজ। রাজনৈতিক ঘটনাবর্তের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন তিনি, ধীরে ধীরে। গোপনে যোগাযোগ হলো জ্যাকবপন্থী বিপ্লবীদের সঙ্গে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে জামর হলেন কমিটি অব পাবলিক সেফটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
বিপ্লবীদের হাতে সম্রাটের পতন ঘটলে প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হলেন মাদাম বারি। ফরাসি অভিজাত শ্রেণির ওপর তাঁর প্রভাব ছিল গভীর। তিনি বিপ্লবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। বিপ্লবীরা তাঁকে গ্রেপ্তার করল, কিন্তু ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো তথ্যপ্রমাণের অভাবে। ৬ ডিসেম্বর ১৭৯৩ তিনি আবার গ্রেপ্তার হলেন। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে এবার হাজির করা হলো জামরকে।
মাদাম বারির কাছে, অন্তত এর আগ পর্যন্ত, জামর তাঁর পরিচয় প্রকাশ করেননি। এবার আদালতে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি আফ্রিকার নই, চট্টগ্রামের ছেলে। দাস-ব্যবসায়ীরা আমাকে মাদাগাস্কার নিয়ে যায়।

ইভ রুজিয়েরের লেখা লো রেভ দো জামর বইয়ের প্রচ্ছদ
ইভ রুজিয়েরের লেখা লো রেভ দো জামর বইয়ের প্রচ্ছদ

সেখান থেকে নিয়ে আসে ফ্রান্সে।’ বিচারসভায় তিনি মাদামের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। তাঁর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে গিলোটিনে প্রাণ হারান মাদাম বারি।
মাদাম বারিকে সহযোগিতার অভিযোগে জামরেরও কারাদণ্ড হয়। তবে ছয় সপ্তাহ পর বিপ্লবী বন্ধুরা তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় জামরের নিভৃত জীবন। ১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে হেরে নেপোলিয়ন নির্বাসিত হলে তিনি আবার প্রকাশ্য জীবনে ফিরে আসেন। বাড়ি নেন প্যারিসে, লাতিন কোয়ার্টারের কাছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর স্বভাব ছিল বদরাগী। ছাত্রদের বেদম পেটাতেন।
মাদাম বারির স্মৃতিকথায় জামরের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘আফ্রিকার কিশোর জামর স্বভাবে ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও দুষ্ট, সরল ও স্বাধীনচেতা; কিন্তু তার দেশের মতোই বুনো। রাজাকে যে কিছুটা সম্মান দেখাত, আর তা কেবল ছদ্মবিনয়ে।’ জামর তাঁকে প্রথমে মুগ্ধ করলেও পরে তা টেকেনি। তিনি লিখেছেন, ‘শুরুতে আমি তাকে পুতুল বা খেলার সামগ্রী হিসেবেই দেখতাম। ধীরে ধীরে বালক ভৃত্যটির ওপর আমার মায়া জন্মাতে থাকে। ছোট্ট এই শজারুটিরও আমার মনোযোগ কাড়ার চেষ্টা ছিল। শেষমেশ সে হয়ে উঠেছিল অভদ্র ও বেয়াড়া।’
ফরাসি লেখিকা ইভ রুজিয়ের তাঁর লো রেভ দো জামর বা জামরের স্বপ্ন (২০০৩) উপন্যাসের মুখবন্ধে বলেছেন, ‘কৈশোরে ভারতের দক্ষিণের বেলাভূমিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জামরের জীবন। সাগর-মহাসাগর আর দ্বীপের বন্দরে বন্দরে কেটেছে জীবনের একটা সময়। দাস হিসেবে সে এসে পৌঁছায় কাউন্টেস বারির কাছে। কৃষ্ণাঙ্গ এ তরুণ একসময় হয়ে ওঠে ভার্সেইবাসীর চোখের মণি। কিন্তু এ সৌভাগ্যের আড়ালে ছিল তিক্ততা ও অসম্মান, যা একসময় তীব্র হয়ে ওঠে।’ মাদাম দ্যু বারি এবং দ্য ওয়েজ অব বিউটির লেখিকা জন হাসলিপ বলেছেন, বিপ্লবের সময় জামর প্যারিস রয়্যাল ক্যাফেতে যাতায়াত করতেন। ইংরেজ বিপ্লবী জর্জ গ্রিভের সঙ্গে সেখানে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ১১ জানুয়ারি ১৭৯১ মাদাম বারির বাড়িতে অলংকার চুরির সঙ্গে গ্রিভ যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে জামরের কাছে শোনা তথ্যের ভিত্তিতে মাদাম বারিকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে গ্রিভ ভূমিকা রাখেন। গ্রেপ্তারের পর গ্রিভ মাদামকে ধর্ষণও করেন।
জামর নামে বাঙালি এই দাসের অকল্পনীয় উত্থানকে অনেকেই মহিমান্বিত করেছেন। কেউ আবার বলেছেন, জামর বিপথগামী; যে মাদাম তাঁকে মায়ের মমতা দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। তবে সবাই এ কথা মেনেছেন যে, জামর ছিলেন বিপ্লবী।
ফ্রান্সের সেকালের কয়েকজন শিল্পী জামরের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। ল্যুভরে রক্ষিত একটি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ফরাসি নারী-শিল্পী মারি-ভিক্তোয়ার লোমোয়ান। তাতে ঘন কোকড়া চুল, পুরু ঠোঁট, উঁচু কপাল ও গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের জামরকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে মনে হয়। তাঁর পরনে অভিজাত ধূসর রেশমি কোট। নিচে উঁকি দিচ্ছে বাহারি লেসের কাজ করা জামা। অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা, এ প্রতিকৃতি অতিরঞ্জিত, সম্ভবত কল্পিত। শিল্পী তাঁকে মাদাম বারির চোখে দেখেছেন। জামরের জীবনতথ্য নিয়ে ১৯৭৮ সালে ফ্রান্স থেকে বেরিয়েছে লা রু পের্দু্য নামে একটি কমিক উপাখ্যান।
৭ ফেব্রুয়ারি ১৮২০ দারিদ্র্য ও অনাহারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় জামর মারা যান। লোকচক্ষুর প্রায় অগোচরে সম্পন্ন হয় তাঁর শেষকৃত্য।