শিশু আইন শিশুদের জন্য একটি মাইলফলক

আগামী দিনের জাতি গঠনে পূর্ণমাত্রায় শিশুর মেধা বিকাশ নিশ্চিত করা এবং শিশুর কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে শিশু আইন, ২০১৩। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন রহিত করে প্রণীত হয়েছে এ আইন। এ আইনের ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিক প্রথম আলোর কাছে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। নিচে সেসব মতামত তুলে ধরা হলো।

শফিক আহমেদ, আইনমন্ত্রী
শফিক আহমেদ, আইনমন্ত্রী

শফিক আহমেদ
আইনমন্ত্রী

শিশুদের সুরক্ষার জন্য শিশু আইন তৈরি করা হয়েছে। এমন একটি আইনের খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শুধু আইন করেই শিশুদের রক্ষা করা যাবে না, এর জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজন বুঝে আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুর যে কয়টি অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তা যেন আমাদের দেশের শিশুরা পায়, সে জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।
শিশুর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিশুকে কখনোই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা উচিত নয়।
উন্নত বিশ্বের কোনো দেশেই শিশুর প্রতি এমন অবিচার করা হয় না। শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ দিতে হবে। সর্বোপরি শিশুকে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সবাইকে একসঙ্গে হ্যাঁ বলতে হবে।

হাসান মাহমুদ খন্দকার, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)
হাসান মাহমুদ খন্দকার, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)

হাসান মাহমুদ খন্দকার
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শিশু আইন, ২০১৩ শিশুদের জন্য কল্যাণমূলক একটি আইন। আগেও এ আইন ছিল। যুগোপযোগী করে নতুন করে আইনটি পাস হওয়ায় আমরা খুবই সন্তুষ্ট।
আইনে শিশুর প্রতি সব অন্যায় আচরণের জন্য দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এ আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পুলিশের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। এ আইনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ও ব্যবহারকারীকে শাস্তির যে বিধান রয়েছে, তা বাস্তবায়নেও পুলিশ অত্যন্ত দায়িত্ববান হবে। তবে তার আগে অন্যদের সচেতন হতে হবে।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। সবাইকে এ আইনের কথা জানাতে হবে।এ জন্য ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালাতে হবে।

মিজানুর রহমান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান
মিজানুর রহমান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান

মিজানুর রহমান

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান

শিশু আইন পাস হওয়ায় আমরা খুশি। তবে কেবল আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। সামাজিক বাস্তবতা পরিবর্তনে আইন সহায়তা করে ঠিকই, কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন তখনই ঘটবে, যখন মানুষ আইন মেনে চলবে।
শিশুদের জন্য নতুন আইনটিতে শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। এতে শিশুকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করলে ব্যবহারকারীকে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি জেলায় শিশু আদালত তৈরির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইনটি যেন শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ না থাকে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে।
কোনো শিশু বা কিশোর অপরাধী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্যান্য সাধারণ অপরাধী থেকে আলাদা করে কিশোর সংশোধন কর্মকর্তার হাতে তুলে দিতে হবে।
সাধারণ শাস্তি না দিয়ে তার আচরণকে সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। তবেই শিশু আইনের সুফল পাওয়া যাবে।

সুলতানা কামাল আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক
সুলতানা কামাল আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক

সুলতানা কামাল

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক

এবার পাস হওয়া শিশু আইনের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি দিক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এবং জেলায় জেলায় শিশু আদালত গঠন করা। আমরা সব সময় বলে এসেছি, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কেননা, শিশুরা নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বলে তারা তাদের ভালো-মন্দও বুঝতে পারে না। তাই তাদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করে তাকে যেভাবে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়, তার কুপ্রভাব সারা জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। তাই এবারের আইনে এটি নিষিদ্ধ করায় অত্যন্ত ভালো হয়েছে। এ ছাড়া এবারের আইনে আর একটি সুখবর হলো জেলায় জেলায় শিশু আদালত গঠন করা।
শিশুদের অন্য অপরাধীদের সঙ্গে বিচার করা ঠিক নয়। এ ছাড়া তাকে বারবার আদালতে হাজির করলে সে মানসিকভাবে নানা জটিলতায় পড়তে পারে। জেলায় জেলায় শিশু আদালত হলে এটি বন্ধ হবে। তবে নতুন শিশু আইনের বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। তাদের আইন সম্পর্কে জানতে হবে। আইন জানা থাকলে তারা এর ব্যবহার সঠিকভাবে করতে পারবে। এ আইন যেমন তাদের জানতে হবে, তেমনি অন্যদেরও জানাতে হবে।

তানজিব-উল আলম,আইনজীবী
তানজিব-উল আলম,আইনজীবী

তানজিব-উল আলম

আইনজীবী

শিশু আইন, ২০১৩ বাংলাদেশের শিশুদের অধিকার রক্ষায় একটি মাইলফলক। এই আইনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো শিশুর বয়সসীমা ১৬ থেকে ১৮ বছরে উন্নীতকরণ, ‘ভিক্ষা’র সংজ্ঞায় ব্যাপক পরিবর্তন, প্রতিটি থানায় শিশুবিষয়ক ডেস্ক স্থাপন, শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা নিয়োগ, সামাজিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ, শিশুর বিচারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারণ, অর্থদণ্ড ও অন্যান্য দণ্ডের লাঘবীকরণ; যা এই আইনকে যুগোপযোগী ও শিশুর অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছে। আগের আইনেও প্রবেশন কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্যান্য অনেক ব্যবস্থা থাকলেও তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
নতুন শিশু আইনে আইনগত সুরক্ষা, শিশুবান্ধব পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বিচারকাজ সম্পাদনের বিধান রাখা হয়েছে।
এগুলো খুবই ভালো দিক। শিশুর সংবেদনশীলতা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কার কারণে শিশুদের জন্য পৃথক আদালত থাকা জরুরি। প্রতিটি জেলায় শিশু আদালত গড়ে উঠলে শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিচারকাজ শেষ করা সম্ভব হবে এবং তা মামলার জট নিরসন ও শিশুর পুনর্বাসনে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে। তবে শিশু আইনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধার উল্লেখ থাকলেও এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের উল্লেখ নেই এবং আইনের বেশ কিছু ধারা ব্যক্তির স্বীয় মূল্যবোধ ও ধারণানির্ভর, যা বিচারের নিরপেক্ষতা ও স্পষ্টতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।

আইনুন্নাহার সিদ্দিকা ,আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
আইনুন্নাহার সিদ্দিকা ,আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

আইনুন্নাহার সিদ্দিকা

আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

এই আইনে যে বিষয়টি প্রথমেই লক্ষ করার মতো, সেটি হচ্ছে শিশুদের বয়স। আগে শিশুদের বয়স নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছিল। কোথাও বলা হয়েছিল, ১৪ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হবে। কোথাও ছিল ১৬ বছর। আবার কোথাও কোথাও ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হতো। এর ফলে আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হতো।
আর ‘শিশু আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী, এখন থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু বলে গণ্য হবে। এটা আমাদের সবারই বহুদিনের প্রত্যাশা ছিল যে শিশুর জন্য যুগোপযোগী একটা আইন তৈরি হবে, যার ফলে শিশুর প্রতি বৈষম্য নিরোধ হবে।
এত দিন হাইকোর্টের কিছু রুল ছিল। তাতে করে কেউ সেগুলো মেনেছেন, কেউ মানেননি। আর এখন আইন হওয়ার পর সবাইকে এটা মানতে হবে।
এ আইনে শিশু আদালত, শিশুকল্যাণ বোর্ড, শিশুবিষয়ক ডেস্ক গঠনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো কার্যকর হলে শিশুর অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের শিশুরা বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

শাবনাজ জাহিরিন
শাবনাজ জাহিরিন

শাবনাজ জাহিরিন

জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) শিশু সুরক্ষা কর্মকর্তা

শিশু আইন, ২০১৩ বাংলাদেশের শিশুদের জন্য বড় একটি মাইলফলক। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এ আইনের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে, ১৮ বছরের নিচে সব মানুষকে শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ আইনে দেশের প্রতি জেলায় শিশু আদালত গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং শিশু ভিকটিম ও সাক্ষী উভয়কে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপরাধের শিকার শিশুকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এটা আইনের খুবই ভালো একটি দিক ।
এ আইনে প্রতিটি থানায় শিশুবিষয়ক ডেস্ক রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ডেস্কে শিশুদের অভিযোগ শোনার জন্য একজন কর্মকর্তা থাকবেন।ফলে শিশুদের অনেক সমস্যার খুব সহজেই সমাধান হবে। শিশুরা তাদের প্রতি যেকোনো অন্যায় আচরণের অভিযোগ এ ডেস্কে জানাতে পারবে। আইনে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় শিশুকল্যাণ বোর্ড গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যা অনাথ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য খুবই ইতিবাচক হবে। এ আইন বিশেষ করে শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইউনিসেফের কাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

নেহাল করিম
নেহাল করিম

নেহাল করিম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেকোনো আইন কেবল কাগজেই থেকে যায়, বাস্তবে এর প্রয়োগ হয় না। সরকার শিশু আইন করেছে, এতে খুশির কিছু নেই। বিভিন্ন আইন করা সরকারের আইওয়াশ ও স্টান্টবাজি। সরকার আইন করে রাজনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহার বন্ধ করবে, ব্যাপারটি আসলে তা নয়। বাস্তবতা হলো, আইনপ্রণেতারাই মূলত আইন ভেঙে থাকেন। দেখা যাবে, তাঁরাই আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার করছেন।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ দেশের নীতিনির্ধারণকারীরা কথায় কথায় সংবিধান বা আইনের কথা বলেন, সংস্কারের কথা বলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মূল্যবোধ ও সৌজন্যবোধের অভাব রয়েছে। যে দেশে শাসকেরা এত বিলাসী, উপজেলা চেয়ারম্যানরাও পাজেরো গাড়ি নিয়ে চলেন, সে দেশের অভাবী-দুঃখী শিশুদের উন্নতি সম্ভব নয়।
এই গরিব দেশে টাকা খরচ করে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত করা অর্থনৈতিক অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করলে বর্তমানে বিদ্যমান আদালতের মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে শিশুদের বিচার করা বা আইনের আওতায় আনা সম্ভব। এই আইন কেবল তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন সরকার রাষ্ট্রীয় অপচয় বন্ধ করবে আর দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।