শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ করবে শিশু আইন

ছবি: মুসলিমা জাহান
ছবি: মুসলিমা জাহান

গায়ে ছিল প্রচণ্ড জ্বর। এই শরীরে ধুচ্ছিল প্লেট-গ্লাসসহ আরও অনেক জিনিসপত্র। অসাবধানে হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় একটি কাচের গ্লাস। আর তাতেই ১০ বছর বয়সী জেসমিনের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। মারধরের পাশাপাশি গৃহকর্ত্রী তার শরীরে দেয় আগুনের ছ্যাঁকা। খুন্তি চুলার আগুনে গরম করে হাত-পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। প্রচণ্ড ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে জেসমিন। চিকিৎসকের কাছে না পাঠিয়ে গৃহকর্ত্রী জেসমিনকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। অমানুষিক এই কাজের জন্য কোনো শাস্তিই হয়নি ওই গৃহকর্ত্রীর। কিন্তু সদ্য পাস হওয়া শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, এখন আর এ ধরনের অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। শিশু আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর দায়িত্বে থাকা শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন বা অবহেলা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

গত ১৬ জুন জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে শিশু আইনের বিলটি পাস হয়। পরে ২০ জুন আইনটি গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এই আইন পাসের আগে ‘শিশু আইন, ১৯৭৪’ রহিত করা হয়।

‘শিশু আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী, এখন থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলে গণ্য করা হবে। মিছিলে, সমাবেশে শিশুদের ব্যবহার করা এখন দণ্ডনীয় অপরাধ। শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তি বা যৌনপল্লিতে ব্যবহার করা হলে অথবা শিশুদের দিয়ে কোনো ধরনের মাদক বা আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ কিছু বহন করানো হলে দায়ী ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হবে।

ইচ্ছে করলেই কোনো ধরনের মামলায় নয় বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনোভাবেই গ্রেপ্তার করা যাবে না। শিশুসংক্রান্ত মামলার দেখাশোনা করবেন নিয়োগ পাওয়া প্রবেশন কর্মকর্তা। আর শিশুর বিচার হবে বিশেষ শিশু আদালতে। নতুন শিশু আইনের ১১টি অধ্যায়ে রয়েছে ১০০টি ধারা।

 শিশু আইনকে ‘বহুদিনের প্রত্যাশিত’ আইন হিসেবে উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের অনেক ভালো আইনের মধ্যে এটি একটি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আইনের কারণে বাংলাদেশের শিশুদের বয়স নির্ধারণের বিভ্রান্তি ঘুচেছে। ফলে শিশুদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা আরও সহজ হবে।’ যথাযথ উপায়ে আইন বাস্তবায়নের পক্ষে জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অনেক ভালো আইন রয়েছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকবে বলেই আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশে ৯৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু বাড়িতে মা-বাবা ও বড়দের কাছ থেকে মৌখিক সাজা (বকা ও গালাগালি) পায়। আর ৪০ শতাংশ শিশুকে বাড়িতে লাথি বা মার খেতে হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার চার হাজার পরিবারের ওপর করা এক জরিপ থেকে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৯১ শতাংশ শিশু স্কুলে বিভিন্ন পর্যায়ের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, ৭৪ শতাংশ বাসায় বড়দের হাতে। এসব নির্যাতনের ধরনের মধ্যে রয়েছে লাঠি দিয়ে মারা, চক বা ডাস্টার ছুড়ে মারা, চড় মারা, কান বা চুল ধরে জোরে টানা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট শিশুর ১০ শতাংশ কাজ করে। ভারী কাজ, কম বেতন, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ ছাড়াও শিশুশ্রমিকের তিন-চতুর্থাংশ প্রতিনিয়ত মার খায়। শিশুশ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ জানায়, কর্মক্ষেত্রে চড়-থাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের।

একনজরে শিশু আইন

প্রবেশন কর্মকর্তা: এ আইনের আওতায় মেট্রোপলিটন, জেলা ও উপজেলা এলাকায় একাধিক প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ করবে সরকার।

শিশুকল্যাণ বোর্ড: শিশুদের উন্নয়নে গঠিত জাতীয় শিশুকল্যাণ বোর্ডের সভাপতি থাকবেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। সদস্যসচিব থাকবেন সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। আইনের বিধানমতে, সব জেলা ও উপজেলায় শিশুকল্যাণ বোর্ড গঠন করা হবে। জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা বোর্ডের সভাপতি হবেন।

শিশুবিষয়ক ডেস্ক: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিটি থানায় কমপক্ষে উপপরিদর্শক (এসআই) ও এর ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে এই ডেস্ক গঠন করবে। সংঘাতে জড়িত শিশু বা আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু কোনো মামলায় জড়িত থাকলে, তা যে আইনেই হোক না কেন, ওই মামলা বিচারের এখতিয়ার কেবল শিশু আদালতের থাকবে। প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে শিশু অধিকার ডেস্কের নিয়োজিত কর্মকর্তার দায়িত্ব কী হবে, তা-ও বলা হয়েছে আইনে।

শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কের একসঙ্গে অভিযোগপত্র নিষিদ্ধ: ফৌজদারি কার্যবিধির ২৩৯ অথবা যে আইনে যা-ই থাকুক না কেন, শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর সঙ্গে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া যাবে না।

শিশু আদালত: শিশুর অপরাধ বিচারে জেলা সদরে ও মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে একটি শিশু আদালত থাকবে।

গ্রেপ্তার: এই আইনের বিধানমতে, নয় বছরের নিচের কোনো শিশুকে কোনো অবস্থায়ই গ্রেপ্তার করা বা আটক রাখা যাবে না। নয় বছরের বেশি কোনো শিশুকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হলে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি পরানো যাবে না। এ ছাড়া যেকোনো মামলায় শিশুকে জামিন দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

শিশুসংক্রান্ত বিশেষ অপরাধের দণ্ড: নতুন আইনে শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার বন্ধ করতে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। পাশাপাশি শিশুদের বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত করার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। শিশুকে নেশাগ্রস্ত করলে এক বছরের জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, মাদক ও বিপজ্জনক ওষুধ সরবরাহ করলে তিন বছরের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখালে তিনি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার বন্ধে শাস্তি: আইনের ৭৯ ধারায় শিশুদের দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ বস্তু বহন এবং সন্ত্রাসী কাজ সংঘটনে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একই ধারায় আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি শিশুর প্রকৃত দায়িত্বসম্পন্ন বা তত্ত্বাবধানকারী হোক বা না হোক, শিশুকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ৬ ধারায় উল্লিখিত কোনো সন্ত্রাসী কাজে নিয়োজিত করলে বা ব্যবহার করলে তিনি স্বয়ং ওই সন্ত্রাসী কাজ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং তিনি ওই ধারায় উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

শিশুকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তথ্য প্রকাশ: বিচারাধীন কোনো মামলা বা বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী এমন কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, যার দ্বারা শিশুকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়। এ বিধান লঙ্ঘন করলে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।