ওরাও সব পারে

এমন আনন্দে মেতে থাকে সব সময়। ছবি: খালেদ সরকার
এমন আনন্দে মেতে থাকে সব সময়। ছবি: খালেদ সরকার

টেবিলের ওপরে একটা ছোট্ট ঝুড়ি। রঙিন কাগজের টুকরায় ভর্তি ভেতরটা। টেবিলের চারপাশ ঘিরে একদল শিশু। ঝুড়ির কাগজ হাতে নিয়ে ফুঁ দিয়ে ওড়াচ্ছে। একটা শিশু চুপচাপ বসে অন্যদের ফুঁ দেওয়া দেখছে। তার চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়। আরেকটি কক্ষে যেতেই দেখা গেল কতগুলো ছেলেমেয়ে কাপড়ে রঙের কাজ করছে। নকশা করা কাঠের টুকরা নীল রঙে চুবিয়ে নিয়ে কালো কাপড়ের ওপরে বসিয়ে ছাপ দিচ্ছে নিপুণ হাতে। কী করছ, জানতে চাইলে হৃদয় নামের ছেলেটি জবাব দিল ‘বলক (ব্লক)।’ শব্দটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পারলেও, সে ব্লকের কাজ করছে একদম নিখুঁতভাবে। হৃদয়ের শিক্ষক এগিয়ে এসে জানালেন, প্রথম দেখাতেই ঠিকমতো বুঝতে পারবেন না। হৃদয় আসলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। হৃদয়ের মতো এ রকম ১১০ জন শিশুর নানা ধরনের কার্যক্রম দেখতে দেখতেই ১৪ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে গেল।
নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেসব শিশুর স্বাভাবিক শৈশব কেড়ে নিয়েছে। করে তুলেছে অন্যদের চেয়ে আলাদা। তেমনই ১১০ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এই স্কুল। ‘সিড ট্রাস্ট কমিউনিটি থেরাপি সেন্টার’ নামে ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকার দক্ষিণ রসুলপুরের ৬৬৫ নম্বর বাড়িতে চলছে এই স্কুলের কার্যক্রম। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সিড ট্রাস্টের গড়ে তোলা এই সেন্টারে সম্পূর্ণ আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সামিট গ্রুপ।
সিড ট্রাস্টের পরিচালক দিলারা সাত্তার বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে দরিদ্র প্রতিবন্ধী শিশুদের নানা ধরনের অধিকার নিয়ে কাজ করছে সিড ট্রাস্ট। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কামরাঙ্গীর চরের এই স্কুলটি ছাড়াও রায়েরবাজার ও শ্যামলিতে আরও দুটি স্কুল পরিচালনা করছি আমরা। প্রি-স্কুল এডুকেশন ছাড়াও এখানে শিশুদের ফিজিওথেরাপি ও কারিগরি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে এখানে কাজ শিখে এখন বাইরে ছোটখাটো চাকরি করছে।’

দেখি তুমি কী বানাচ্ছ?
দেখি তুমি কী বানাচ্ছ?

দিলারা সাত্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই স্কুলে এসে পৌঁছালেন সামিট গ্রুপ অব কোম্পানিজের পরিচালক আজিজা আজিজ খান। তিনি সিড ট্রাস্টের একজন বোর্ড অব ট্রাস্টি। আজিজা আজিজ খানকে দেখেই কয়েকটি শিশু তাঁকে সালাম দিয়ে কাছ ঘেঁষে এসে বসল। স্নিগ্ধ একটা হাসি দিয়ে তাঁদের কাছে টেনে নিয়ে আজিজা আজিজ খান বলেন, ‘এরা কিন্তু অনেক মেধাবী। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে না পারলেও এরা অবাক করে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই পারে। একটা সুন্দর ও পরিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য এসব শিশুরও সামনে এগিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।’
একটা শ্রেণিকক্ষে ঢুকে আজিজা বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে একটা সেলফি তুললেন।
সাধারণত ছয় বছরের শিশুদের এখানে প্রি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়। তবে এক মাসের প্রতিবন্ধী শিশু হলেও তাকে থেরাপি বা নানা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা হয়। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত এখানে পড়াশোনা, ফিজিওথেরাপি ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে এসব শিশুকে দক্ষ করে তোলার কাজ চলে। এর পরের দুই ঘণ্টা সময় শুধু ফিজিওথেরাপি দিতে আনা শিশুদের জন্য বরাদ্দ। স্কুলটির শ্রেণিকক্ষের নামকরণ করা হয়েছে অপরাজিতা, কুসুমকলি-১, কুসুমকলি-২, অঞ্জলি ও গোলাপ নামে। প্রতি ১০ জন শিশুর জন্য একজন করে শিক্ষক, একজন থেরাপিস্ট ও একজন আয়া দিয়ে কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে এখানে। অনাবাসিক এই স্কুলে ছেলেমেয়েদের নিয়মিত দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। সিডের স্কুলে শুধু সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের ভর্তি নেওয়া হয়। ৪০০ টাকার নিবন্ধন ফি দিয়ে শিশুকে ভর্তির পর সব ধরনের শিক্ষা উপকরণ, স্কুল ড্রেস ও নিয়মিত দুপুরের খাবার সরবারহ করা হয় বিনা মূল্যে। সারা দিন ঘোরাঘুরি আর তথ্য সংগ্রহের পর ফিরে আসব, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়াল প্রতিবন্ধী কিশোরী শিলামণি। সে একটা দেশের গান শোনাতে চায়। ‘শোনাও’ বলতেই শুরু করল, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল/ আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল... একটি কথা আমি শুধু বলে যেতে চাই/ বাংলা আমার সুখে-দুঃখে হয় যেন গো ঠাঁই রে, হয় যেন গো ঠাঁই।’