প্রবাসে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা

ফিলিপাইনের একদল পুলিশ। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবি
ফিলিপাইনের একদল পুলিশ। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবি

সংগীত ফিলিপিনোদের জীবনের সঙ্গে বাতাসের মতো মিশে আছে। কথা বলতে পারে কিন্তু গান জানে না বা গান ভালোবাসে না, এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। তাই অনেকে ফিলিপিনোকে মিউজিক্যাল আইল্যান্ড বলেন। তাদের যেকোনো অনুষ্ঠানে সংগীতের আয়োজন থাকা চাই।
কয়েক দিন আগে আমি গিয়েছিলাম মিন্দানাও প্রদেশে। কার্যোপলক্ষে কিছুদিন পর পরই আমাকে সেখানে যেতে হয়। এবার একদিন কাজ শেষে এক সংগীতসন্ধ্যায় টেবিল ঘিরে সহকর্মীদের সঙ্গে বসে গান শুনছি। গানের তালে তালে উপস্থিত সবার মাথা দুলছে। পরিবেশিত হচ্ছিল ইংরেজি কড়া ব্যান্ডের গান। এই গানের ভক্ত আমি কোনো দিনই ছিলাম না। এখনো নয়।
সেদিন সহকর্মীদের সঙ্গ দিচ্ছিলাম। অনুষ্ঠানস্থলে কিছু টোকাই ধরনের কিশোর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের একজন এসে হাত বাড়াতেই আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে পাঁচ পেসোর একটি মুদ্রা তার হাতে দিলাম। এরা উপজাতীয় টোকাই। এদের ছাড়া ভিক্ষুক এ দেশে খুব একটা চোখে পড়ে না।
টোকাই কিশোরকে বিদায় করে আবার গানে মন দিলাম। হঠাৎ পাশের টেবিলের এক মহিলা আমাকে পকেট দেখতে বললেন। পকেটে হাত দিয়ে আমি অবাক। দেখি আমার মানিব্যাগ নেই। ওর মধ্যে আমার জীবনের অর্ধেকটা বলা চলে। নগদ টাকা, এটিএম কার্ড, এলিয়েন কার্ড (কাজের অনুমতি কার্ড), এসিআর কার্ড (ভিসাধারীদের বিশেষ এক কার্ড) ইত্যাদি।
এই কার্ডগুলো ছাড়া আমি এ দেশে বৈধ নই। পুলিশ আমাকে যেকোনো সময় আটক করতে পারে। আমি হকচকিত হয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকাতেই বললেন, যে টোকাইকে আমি পাঁচ পেসো দিয়েছিলাম, সে-ই আমার পকেট থেকে মানিব্যাগ জাতীয় কিছু একটা নিয়ে গেছে।
আমার সহকর্মীরা চারদিকে তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। আমার মাথায় তখন এক রাজ্যের চিন্তা। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলে হয়তো পুলিশি হয়রানি হবে না, কিন্তু কার্ডগুলো পুনরায় পেতে অনেক হ্যাপা পোহাতে হবে।
এসব সাতপাঁচ যখন ভাবছি, তখন আমার এক সহকর্মী সেই টোকাই ছেলেটাকে ধরে নিয়ে এলেন। মানিব্যাগটাও ফেরত পেয়েছেন। ভেতরে কী আছে, দেখার সুযোগ পাননি। আমি রাগ সামাল দিতে না পেরে টোকাই ছেলেটির গালে এক চড় বসালাম। সঙ্গে সঙ্গে দুজন ফিলিপিনো এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন কী হয়েছে?
আমার সহকর্মী তাঁদের ঘটনা বলতেই তাঁদের একজন আমাকে বললেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, কিন্তু আপনি তো ওর গায়ে হাত তুলতে পারেন না। তারপর তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমাকে তাঁদের আইডি কার্ড বের করে দেখালেন। তাঁরা পুলিশের লোক। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে তাঁরা কর্মরত।
এদিকে আমার মানিব্যাগে কার্ডগুলো পেলেও কোনো টাকা পেলাম না। টোকাই ছেলেটিও কথা বলছে না। পুলিশের ওই লোক দুজন আমাকে তাঁদের সঙ্গে পুলিশ স্টেশনে যেতে বললেন। তাঁদের কথায় আমি একটু ভয়ই পেলাম। কারণ, আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় জানি পুলিশ মানেই হয়রানি। এ দেশে আমি আছি কয়েক বছর হয়। তাঁরা কেমন, তা জানি না।
যা হোক, তাঁদের সঙ্গে রওনা হলাম। পুলিশ স্টেশন খুব নিকটেই। ভেতরে যেতেই তাঁরা বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিয়ে কফি অফার করলেন। তাঁরাও কফি পান করলেন। কফি শেষ করে ডিউটি অফিসার ছেলেটিকে আলাদা একটি ঘরে নিলেন। সেখানে আমাকেও ডেকে চেয়ারে বসালেন।
এরপর আমার সামনেই তিনি ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। কোনো মারধর নয়। বড় একটি ছুরি বের করে ভয় দেখালেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় মুখ-চোখে রাগ ফুটিয়ে পিস্তল দেখিয়ে গুলি করার হুমকি দিতেই টোকাই ছেলেটি তার জাঙ্গিয়ার মধ্যে থেকে টাকা বের করে ডিউটি অফিসারের হাতে দিল।
অফিসার আমাকে টাকা গুনে দেখতে বললেন। গুনে দেখলাম তিন হাজার পেসো। আনুমানিক আরও দুই হাজার পেসো নেই। এটা অফিসারকে জানালাম। এবার ছেলেটি বলল তার আরও একজন সঙ্গী আছে। সে দুই হাজার পেসো নিয়েছে। ভাগ নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। তার বাড়ি ওখান থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ।
তখন প্রায় মাঝরাত। পুলিশ অফিসার আমাকে জানালেন, আমি কিছু মনে না করলে তাঁরা সকালে অভিযান চালাতে চান। আমি তাতে সম্মতি দিলাম। তাঁরা আমাকে পৌঁছে দিতে চাইল। আমি জানালাম, তার প্রয়োজন নেই, আমার সহকর্মীরা আছে। তার পরও তাঁরা পৌঁছে দিলেন।
সকালে আমার ঘুম ভাঙল গাড়ির হর্নে। নিচে নেমে দেখি পুলিশের গাড়ি। কিছুটা চমকে গেলাম। ভাবলাম, না জানি তাদের কী মতলব। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন গত রাতের সেই পুলিশ অফিসার। গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন ঘুম ভাঙানোর জন্য।
যা হোক, তিনি জানালেন, গতরাতেই তাঁরা অভিযান চালিয়ে সেই ছেলেটিকে আটক এবং তার কাছ থেকে বাকি দুই হাজার পেসোও উদ্ধার করেছেন। আমি যেন পুলিশ স্টেশনে গিয়ে টাকা নিয়ে আসি। এ জন্যই তাঁর এই সাতসকালে আগমন।
পুলিশ অফিসার আমাকে আরও জানালেন, ছেলে দুজন যেহেতু নাবালক, তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তারা ছাড়া পেয়ে যাবে। আমি যদি অভিযোগ না করে সংশোধনের অনুরোধ জানাই তাহলে তাঁরা সরাসরি তাদের শিশু সংশোধনাগারে পাঠাতে পারবেন।
আমি এক সহকর্মীর সঙ্গে বিকেলে পুলিশ স্টেশনে গেলাম। একটি কাগজে সই করে টাকাটা নিয়ে ছেলে দুজনকে সংশোধন করার অনুরোধ জানিয়ে আমি তাঁদের পরামর্শমতো জিডি করলাম।
ফিরে আসার সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, সম্ভব হলে তাঁরা যেন আমাদের কর্মস্থলে এসে কফি খেয়ে যান। আমার আমন্ত্রণে তাঁরা কিছুটা লজ্জিত হয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন এই দুর্ঘটনার জন্য। এরপর তাঁরা আমাদের পাশের এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন কফি খেতে। সেই সেখানে কফি খেতে খেতে নানা কথা হলো। এ সময় মনে হচ্ছিল তাঁরা যেন পুলিশ নয়, অনেক দিনের বন্ধু।

মুরাদুল ইসলাম
সানপাবলো সিটি, ফিলিপাইন
<[email protected]>