ভাইবোনের বিদ্যানন্দ

ভাই কিশোর কুমার দাশ সুদূর পেরুপ্রবাসী। আর বোন শিপ্রা দাশ আছেন ঢাকায়। ভাইবোন মিলে কীভাবে দাঁড় করালেন বিদ্যানন্দ নামের ব্যতিক্রমী এক সংগঠন? আর কীভাবেই বা সেই সংগঠন একদল বঞ্চিত শিশুর জন্য হয়ে উঠল আনন্দময় উপলক্ষ?

শুধু পরীক্ষা পাস করতে নয়, নিজের খুশিতেই ওরা পড়তে আসে বিদ্যানন্দে। ছবি: সৌরভ দাশ
শুধু পরীক্ষা পাস করতে নয়, নিজের খুশিতেই ওরা পড়তে আসে বিদ্যানন্দে। ছবি: সৌরভ দাশ

স্কুল থেকে ফেরার পর ‘বাড়ির কাজ’ অনেক বাচ্চার জন্যই একটা খুব বিরক্ত আর আতঙ্কের কারণ। টেবিলে বই-খাতার মাঝে বসে আমরা প্রায় সবাই স্বপ্ন দেখেছি এমন একটা প্রতিষ্ঠানের, যেখানে পড়ালেখা বেশ আনন্দের ব্যাপার হবে। গৎবাঁধা বই-খাতার পড়ালেখা আর ক্লাস হয়তো থাকবে, কিন্তু ইচ্ছে হলেই হাতে নেওয়া যাবে গল্পের বই বা হারমোনিয়াম। যে বাচ্চাটা কারও জানালার গ্রিল ধরে নাচের অনুষ্ঠান দেখে নিজের পায়ে ঘুঙুর কল্পনা করে বা যে ভাবে একদিন আমিও নায়ক হব, তার সে সুযোগ আর স্বপ্নটা নিয়ে নেয় বাস্তবতার চাপ।
বিদ্যানন্দের হাত ধরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ আর চট্টগ্রামের বাচ্চাদের এখন সে স্বপ্ন পূরণের একটা সুযোগ হয়েছে। অবশ্য প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ এটাকে কোনোভাবেই স্কুল বলতে রাজি নন। তাঁর বোন শিপ্রা দাশ, যিনি নারায়ণগঞ্জ শাখার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তিনিও না। কিশোর পেরু থেকে ই–মেইলে জানালেন, ‘আমরা সাধারণ স্কুল করতে চাইনি। স্কুলের পড়ালেখার চাপে নিজেদের দুর্বল ভাবা বাচ্চাদের পাশে থাকতে চেয়েছি বরং।’

বিদ্যানন্দে ওরা আসে ছবি দেখার মজা পেতেও। ছবি: সুমন ইউসুফ
বিদ্যানন্দে ওরা আসে ছবি দেখার মজা পেতেও। ছবি: সুমন ইউসুফ

পাশেই আছি আমরা
বিদ্যানন্দ শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত কোনো স্কুল না। এটা প্রাইভেট কোচিং সেন্টারও না। তবে বিদ্যানন্দ কী আর কেন এমন প্রশ্নে কিশোর কুমার দাশ বললেন, ‘আমি একটু গরিব পরিবার থেকে এসেছি। আবার খুব একটা ভালো ছাত্রও ছিলাম না। স্কুলে যা পড়ানো হতো, সবার সাথে বসে সেটা বুঝতে পারতাম না। আবার বাড়ি ফিরে কারও কাছে প্রাইভেট পড়তে যাব, সে সামর্থ্যও ছিল না। আমার খুব বই পড়ার শখ ছিল। অন্য বাচ্চাদের মতো আমিও গান শিখতে, ছবি দেখতে চাইতাম। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। আমার মতো হয়ে ওঠেনি এমন বাচ্চাদের নিয়েই বিদ্যানন্দ।’
কিশোর কুমারের কথার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক নোমান যোগ করলেন আরও কিছু কথা ‘ছোটবেলায় সব বাচ্চা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নগুলো ফিকে হতে শুরু করে। কারও হয় না মেধার অভাবে, কারও সুযোগ নেই আবার কারও পরিবারের সামর্থ্য নেই। অথচ আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনা আছে। আমরা সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের ভেতর থেকে সেই সম্ভাবনাটা বের করে আনি। সে ডাক্তার না হতে পারুক, অন্তত হতাশা বা সুযোগের অভাবে ঝরে না পড়ুক। খুব ভালো কিছু না করুক অন্তত ভালো মানুষ হোক। এই আমাদের আশা।’
কাজে যারা অনন্য
বিদ্যানন্দের কাজ নিয়ে বললেন আরেক স্বেচ্ছাসেবক হাসানুর রহমান। ‘বিদ্যানন্দে আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত পড়ালেখায় সাহায্য করি। তিন শাখা মিলে আমাদের প্রায় চার-পাঁচ শ শিক্ষার্থী আছে। কারও বই-খাতা কেনার সামর্থ্য না থাকলে আমরা বই-খাতাও দেই। হালকা কিছু খাবারের ব্যবস্থাও আছে।’
এ তো গেল সাধারণ দিনের কথা। রইল ছুটির দিন। এই ছুটির দিনগুলো বিদ্যানন্দের আনন্দ দিবস। সপ্তাহের প্রথম শুক্রবার তারা বাচ্চাদের নিয়ে ছবি দেখে। কোনো শুক্রবার নাচ-গান শেখানো হয়, কোনো শুক্রবার ওদের উৎসাহ দিতে ওয়ার্কশপ হয় আর মাসের শেষ শুক্রবার, সে মাসে যেসব ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকের জন্মদিন থাকে, সেটা পালন করা হয়।
এ ছাড়া বিদ্যানন্দের প্রতিটি শাখায় আছে হাজার হাজার বই। এই বই পড়তে পারবেন সবাই। শুধু বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে বসে পড়া যাবে। যেকোনো বয়সের মানুষ বই পড়তে পারবেন এখানে।
এ ছাড়া লিখতে ভালোবাসে এমন ১০০ কবি আর ২০ জন গল্পকারের লেখা নিয়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৫’তে বিদ্যানন্দ দুটি বই প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে। এখন পরবর্তী বইয়ের জন্য লেখা নেওয়া আর বাছাই চলছে।

কেউ ইচ্ছে করলে শিখতে পারে গানও
কেউ ইচ্ছে করলে শিখতে পারে গানও

আনন্দ সকলের
ঘুরে দেখতে গিয়ে কথা হয় তৃতীয় শ্রেণির পড়া লামিয়ার সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারি বাড়ির আর্থিক দুর্দশার কথা। বিদ্যানন্দে পড়তে আসার কারণ জানতে চাইলে বলে ‘এখানে ভালো পড়ায়, আবার খেতেও দেয়!’ লামিয়ার সঙ্গে যোগ করে নবম শ্রেণির ছাত্র আলম। বলে, ‘ক্লাস এইট আর নাইনের পড়ায় যে পার্থক্যটা আছে, সেটা আমাকে হতাশ করেছিল। এখানে এসে সে ভয়টা কেটে গেছে!’
এদের সঙ্গে যোগ করে কলেজছাত্র আরিফ আর আকাশ। বলে ‘এখানে আমাদের কেউ বকে না। বিরক্ত হয় না। পড়ালেখা যে আনন্দের ব্যাপার হতে পারে, সেটা ১০ বছর পড়ালেখা করার পর বুঝতে পারছি।’

ভাইবোনের উদ্যোগ: শিপ্রা দাশ ও কিশোর কুমার দাশ
ভাইবোনের উদ্যোগ: শিপ্রা দাশ ও কিশোর কুমার দাশ

অনেকটা একই রকম কথা বলে প্রিয়া। সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। বলল, ‘স্কুলে বা অন্য কোচিংয়ে একটা জিনিস না বুঝলে বারবার প্রশ্ন করা যায় না। সবাই বিরক্ত হয়। এখানে এই ভয়টা নেই। যতক্ষণ না বুঝি, আমাকে বোঝানো হয়।’
হিমু অবশ্য অন্য কারণে খুশি। পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। বলে ‘বাসায় টিভি নাই। কিছু দেখতে পারি না। এখানে ছবি দেখায়। পড়ালেখা শেষে আবার খেতেও দেয়!’
বিদ্যানন্দের শিক্ষকেরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত জীবনে কিছু করছেন। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে এখানে কেন? এ বিষয়ে মিরপুর শাখার পরিচালক ফারুখ আহমেদ বলেন, ‘কাজ করতে হচ্ছে জীবন চালানোর জন্য। আর নিজের খুশি খুঁজে পাই এখানে।’
২০১১ সালে কিশোর কুমার দাশ পেরুতে চলে যান। এখন কাজ করছেন পেরুর একটি কোম্পানির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে। ২০১৩ সালের আগস্টে বিদ্যানন্দ নিয়ে বোন শিপ্রা দাশের সঙ্গে কথা হয়। এরপর নভেম্বর–ডিসেম্বরের দিকে বোন শিপ্রা দাশ এই ভাবনায় গতি আনেন। আর ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর বিদ্যানন্দের নারায়ণগঞ্জ শাখার যাত্রা শুরু হয়। এরপর বিদ্যানন্দের চট্টগ্রাম শাখা কাজ শুরু করে ২০১৪ সালের মার্চ। সবশেষে ২০১৪ সালের জুলাইতে বিদ্যানন্দের মিরপুর শাখা খোলা হয়। বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার আর নারায়ণগঞ্জ শাখার পরিচালক শিপ্রা দুই ভাইবোন ব্যক্তিগত সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছেন এই স্কুলের জন্য। শিপ্রা বললেন, ‘স্কুলটা এখনো আমরা নিজেদের টাকায় চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু ধীরে ধীরে খরচ বাড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি বই আর টি-শার্টের মাধ্যমে কিছুটা টাকা জোগাড় করতে। এ ছাড়া কেউ এখানে পড়তে চাইলে, পড়াতে চাইলে বা খাবার দিয়ে সাহায্য করতে পারলে আমাদের সঙ্গে যেকোনো সময় যোগাযোগ করতে পারেনন।’ এ বিষয়ে আরও জানা যাবে www.bidyanondo.org থেকে।
ফেরার সময় মিরপুর শাখার শিক্ষার্থী আর শিক্ষকেরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘আমরা করব জয়...’ শুনিয়ে দিল। এ যুগে নিজের কষ্টের উপার্জন খরচ করে অন্য কারও চোখে স্বপ্ন তুলে ধরা নেহাত সহজ বিষয় নয়!

িনজেদের ছবি হাতে ওরা
িনজেদের ছবি হাতে ওরা

ফ্রেমে বাঁধা শৈশব
ফ্রেমে বাঁধা শৈশব বিদ্যানন্দের উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত ১০ হাজার শিশুর ছবি সংরক্ষণের একটি প্রকল্প। এর আওতায় তারা বিভিন্ন এতিমখানা, বস্তি কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের বিদ্যালয়গুলোয় গিয়ে শিশুদের ছবি তুলে তা প্রিন্ট-লেমিনেটিং করে তা তাদের হাতে তুলে দেয়। শৈশবের এই স্মৃতিটুকু হয়তো তাকে জীবনের বাকি দিনগুলোয় কিছুটা উচ্ছলতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত চার হাজার শিশুর ছবি তোলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকেরা চাইলে শুধু ছবি তুলে দিয়ে বা ছবি লেমিনেটিং করে এই প্রকল্পে সহায়তা করতে পারেন।