মীনা, রাজু ও মিঠুর কথা

প্রমিতা গাঙ্গুলি দেন মীনার কণ্ঠ
প্রমিতা গাঙ্গুলি দেন মীনার কণ্ঠ

বন্যার সময় বৃষ্টি বেশি হইলে খাল-বিল বা পুকুরের পানিতে আমরা একটা কঞ্চি পুঁইতা রাখি, এইট্যা দিয়া বুঝতে পারি, বন্যা কতখানি হইল। এইট্যা আমি আমার বাবার কাছ থেইক্যা শিখছি—এই সংলাপটা আমার পুরো মুখস্থ। আসলে যখন যে পর্বের কাজ করি, তখন সেটার সংলাপ মুখস্থ হয়ে যায়। পরে অতটা মনে থাকে না। কিন্তু এটা বেশ মনে আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে মীনা কার্টুনের যে পর্বটা হয়েছিল, এটা তারই অংশ।’ এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে খানিকটা দম নিলেন প্রমিতা গাঙ্গুলি। তারপর মীনার কণ্ঠ অনুকরণ করে বললেন, ‘কী, বুঝলেন...?’ অনুকরণ করতে তাঁর বিশেষ কোনো কসরত করতে হয় না। কারণ, মীনা কার্টুনে মীনা চরিত্রে কণ্ঠ দেন স্বয়ং প্রমিতাই। সে কথাই জানালেন তিনি। ‘তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি আমি। ২০০৫ সাল। মীনার কণ্ঠের জন্য অডিশন দিলাম। ভাবতে পারিনি, আমাকেই নির্বাচন করবে।

রাজুর কণ্ঠটি আবরার সাজিদের
রাজুর কণ্ঠটি আবরার সাজিদের

খুব ভালো লেগেছিল আমার প্রিয় একটা চরিত্রে কণ্ঠ দিতে পারব ভেবে।’সেদিনের ছোট্ট প্রমিতা আজ অনেক বড়। পড়ছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রকৌশল বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা অন্য আর দশটা কাজের মতো নয়। এর মাধ্যমে আমি জনগণকে অনেক পরামর্শ দিতে পারছি। আমার মুখের কথাগুলো অনেকেই অনুসরণ করছে। মেয়েদের উন্নতির জন্য কাজ করছি। এটাই তো আমার কাজের অনেক বড় স্বীকৃতি।’
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি মীনার চরিত্রে কণ্ঠ দেন, এতে আপনার বন্ধুদের অনুভূতি কেমন?
আমার বন্ধুরা তো প্রথমে বিশ্বাসই করত না। তখন তাদের কার্টুনের শেষে যে নামের তালিকাটা দেখায়, সেখানে দেখালাম, ভয়েস অব মীনা—প্রমিতা গাঙ্গুলি। তারপর বিশ্বাস করল। তারপর তো অনেকে আমাকে মীনা বলেই ডাকত।’ গল্প শোনাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘একটা ঘটনা বলি! গুগলে আমার নাম লিখে অনুসন্ধান করলে মীনার একটা রিপোর্ট আসে। সেখানে আমার নামটা শুরুতেই আসে। ওরা বলে, এই এখানেও তোর নাম! সত্যিই, তোর নাম তো! আমার বেশ মজাই লাগে। প্রায়ই যেটা আমার করতে হয়, সেটা হচ্ছে মীনার কণ্ঠ শোনানো। কথা নেই বার্তা নেই, একজন আবদার করে বসল, “এই, মীনার ভয়েসটা করে এই কথাটা শোনাও তো!” অগত্যা করতেই হয়।’ প্রমিতা গাঙ্গুলি মীনা কার্টুনের মাধ্যমেই দেশের জন্য আরও অনেক কাজ করতে চান।

মিঠুর কণ্ঠটি কামাল আহসানের
মিঠুর কণ্ঠটি কামাল আহসানের

পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, মীনার ছোট ভাই রাজুর কথা। রাজু সব ধরনের দুষ্টুমিতে মীনাকে মাতিয়ে রাখে। রাজুর ভূমিকায় কণ্ঠ দিচ্ছে আবরার সাজিদ পাশা। অবশ্য বাবা-মা রোদ্দুর বলে ডাকেন। ও এখন অরণি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। প্রথম যখন অডিশনে রাজুর ভূমিকায় কণ্ঠ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, তখন পড়ত প্রথম শ্রেণীতে। কথায় কথায় সেটাই জানিয়ে দেয় আবরার। বলে, ‘রাজুর ভূমিকায় কণ্ঠ দিতে বেশ ভালো লাগে। বিভিন্ন পর্বে অনেক ভালো ভালো কথা বলে মানুষকে অনেক তথ্য জানাতে পারি। আমার আব্বু জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করে। আর আমিও জাতিসংঘের একটি সংগঠনের হয়ে কাজ করছি। আব্বুর সঙ্গে আমার কাজের একটা মিল আছে। এ জন্য আব্বু-আম্মুও অনেক উৎসাহ দেয় আমায়।’ এক ফাঁকে আবরার জানিয়ে দেয় শুধু কার্টুনেই নয়, রাজুর কথা শুনতে হলে এখন প্রতি শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় বাংলাদেশ বেতারে ‘আমি মীনা বলছি’ অনুষ্ঠানটি শুনলেই হবে। আবরার সেখানে নিয়মিত রাজুর ভূমিকায় কণ্ঠ দিচ্ছে।
পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, এবার কার কথা বলব! মীনার ছোট্ট আর দুষ্টু টিয়াপাখি মিঠু। ওর কথা তো সবার মনে আছেই। সেই যে কথা বলা শিখতে শিখতে ‘আমার নাম মিঠু...’ বলতে পারা! আর ডানা ঝাপটানো! কী ভাবছেন, মিঠু একটি টিয়াপাখি। তাকে খুঁজে পেলাম কেমন করে? ভুলটা ভেঙে দিলেন একজন। অবিকল টিয়াপাখির মতো করে বললেন, ‘আমার আসল নাম কামাল আহসান। বন্ধুরা আমাকে বিপুল বলেও ডাকতে পারো।’ টিয়াপাখি মিঠুর কণ্ঠ দিচ্ছেন কামাল আহসান। কবে থেকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমি শুরু থেকেই মুস্তাফা মনোয়ার স্যারের সঙ্গে পাপেট শো করতাম। সেখানে বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠ দিতে হতো। ১৯৯৮ সালে সবেমাত্র ডিগ্রি পাস করেছি। আমাকে বলা হলো টিয়াপাখির মতো করে কণ্ঠ দিতে। আমি চেষ্টা করলাম। আর আমাকে নির্বাচনও করা হলো।’
কামাল আহসান মূলত মঞ্চ, বেতার ও টেলিভিশনের অভিনয়শিল্পী। একই সঙ্গে তিনি পাপেট শোতে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে কণ্ঠ দেন।
টিয়াপাখির কণ্ঠ দিতে কি কোনো সমস্যা হয়েছিল আপনার, প্রশ্ন করি? খানিকটা থেমে তিনি বলেন, ‘যখন আমাকে টিয়াপাখির ভূমিকায় নেওয়া হলো, তখন থেকেই পাখিদের আচরণ দেখতে শুরু করলাম। পাখি কেমন করে বসে, কেমন করে খায়, কেমন করে ডানা ঝাপটায়—এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।

‘যেহেতু আগে থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত, জাদুকরি যদি (ম্যাজিক ইফ) তত্ত্বটা জানাই ছিল। নিজেকে পাখির মতো ভাবতে শুরু করলাম। বাতাস এলে পাখি কী করে, পর্যবেক্ষণ করতাম। ধীরে ধীরে ট্যার..ট্যার..ট্যাট এই রকম অনেক শব্দ নিজেই রপ্ত করে ফেললাম।’

দেশের সবাই আপনাকে মিঠু নামেই চেনে, এটা ভাবতে কেমন লাগে?

‘আজ আমি যখন বাসা থেকে বের হচ্ছি, আমার ছেলে বায়না ধরল আমার সঙ্গে যাবে। ওকে বললাম মিঠুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ও মিঠুর কথা শুনে খুব মজা পায়। তবে, ও এখনো অনেক ছোট। তাই বুঝতে পারে না যে ওটা আমিই করি। বলল, “তুমি মিঠুকে আমার কথা বোলো।” শুধু আমার ছেলেই নয়, অন্য অনেক শিশুর কল্পনায় আমার একটা অবস্থান আছে।’

মিঠুর চরিত্রে কণ্ঠ দিতে গিয়ে কোনো বিড়ম্বনায় কি পড়তে হয়?

‘আসলে এটা ঠিক বিড়ম্বনা নয়। কেউ যখন জানতে পারে, আমি মীনা কার্টুনের মিঠু, তখন আবদার করে, একটু মিঠুর মতো করে বলেন তো! আমি বাধ্য ছাত্রের মতো শুনিয়ে দিই মিঠুর কণ্ঠ। ওরা মজা পায়। আসলে মানুষকে আনন্দ দিতে পারছি, একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে পারছি, এটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। মিঠুর চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়াটা আমার জীবনের একটা বড় ঘটনা।’