আমই আমার অবলম্বন

আমবাগানে নূরুন্নাহার, ছবি: প্রথম আলো
আমবাগানে নূরুন্নাহার, ছবি: প্রথম আলো

উঠান থেকেই বাগানের শুরু। বাড়ির সঙ্গেই সাড়ে তিন বিঘা জমির আমবাগান। আমের ভারে নুইয়ে পড়া ডাল প্রায় মাটি ছুঁয়ে আছে। এ দৃশ্য নূরুন্নাহারের বাড়ির। তাই তাঁর বাড়িতে ঢুকতে, বের হতে সাবধান থাকতে হয়। শরীরে লেগেই পড়ে যেতে পরে আম। সারা বাড়ি ঘিরে আছে আমগাছে। একইভাবে মাঠের সব জমিতেই তিনি আমবাগান করে ফেলেছেন।
কম বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়েছিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই স্বামী মারা যান। দুই শিশু সন্তান নিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। এই দুঃসময়ে তিনি আমগাছকেই অবলম্বন হিসেবে বেছে নেন। আম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন, সন্তানদের বড় করেছেন।
নূরুন্নাহারের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার অমরপুর গ্রামে। বয়স কত হয়েছে হিসাব করে বলতে পারেন না। শুধু এটুকু মনে করতে পারেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের এক বছর আগে খুব অল্প বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরপরই তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়েসন্তান হয়। ছেলের বয়স যখন সাত আর মেয়ের বয়স তিন, তখন দুষ্কৃতকারীদের হাতে স্বামী জামাল উদ্দিন নিহত হন। সেটা এখন থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের ঘটনা।
একমাত্র ছেলের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে তার শ্বশুর ময়েজ উদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক বছর পরই তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার সময় তিনি নূরুন্নাহারকে বলে যান, ‘আমি মারা গেলে তুমি আর একা এখানে থাকতে পারবে না। তুমি তোমার বাবার বাড়িতে চলে যেয়ো।’ তারপরও নূরুন্নাহার স্বামীর ভিটা ছাড়েননি। এ সময় তাঁর শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম তাঁকে সাহস দিয়েছেন। তিনি এক রাতের জন্যও বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকেননি। শ্বশুর মারা যাওয়ার দুই বছরের মাথায় নূরুন্নাহারের বাবা ওয়াহেদ সরদারও মারা যান। একে একে নূরুন্নাহারের চারপাশ খালি হয়ে যেতে থাকে। তবে তাঁর ভাইয়েরা এসে সংসারের কাজ করে দিয়ে যেতেন।
এ সময় তাঁর ভাইয়ের জামাই রহিমুদ্দিন তাঁকে আমগাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সব জমিতে আমগাছ হয়ে গেলে সন্তানদের মানুষ করতে আর কষ্ট হবে না। তাঁর পরামর্শে তিনি সব জমিতে আমগাছ লাগানো শুরু করেন। এভাবে গাছ লাগানো দেখে প্রতিবেশী আবুল কাশেম এসে বলেন, এভাবে ভালো ভালো জমিতে আমগাছ লাগিয়ে শুধু জমি নষ্ট করা হচ্ছে। নূরুন্নাহার বলেন, এসব কথায় তিনি আর কান দেননি। এখন তাঁর ১২ বিঘা জমির প্রায় সবটাতেই আমগাছ লাগানো হয়ে গেছে। এখন প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারেন। ছোট আমগাছের মধ্যে এখনো সাথি ফসল হচ্ছে। সংসারে তাঁদের আর কোনো অভাব নেই। অংশীদারদের চার বিঘা জমি ছেড়ে দিতে হয়েছিল। পরে সেই চার বিঘা জমিও তিনি কিনে ফেলেছেন। এ কারণেই ভালো বাড়িঘর করতে পারেননি। এখন ধীরে ধীরে বাড়িঘরেও হাত দেবেন।
ছেলে কামাল হোসেন দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে সংসারে হাল ধরেছেন। মেয়ে বিউটি খাতুনও দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। গত চার বছর আগে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২৪ মে অমরপুর গ্রামের নূরুন্নাহারের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। যাওয়ার পথে স্থানীয় অমরপুর বাজারে ছেলে কামাল হোসেনকে পাওয়া যায়। সেখানে তাঁর একটি মুদি দোকান রয়েছে। তিনি খুব শৌখিন মানুষ। ওই বাজারে তিনি একটি সংগীত একাডেমিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে তিনি কি-বোর্ড বাজান। সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ওই সময় মা নূরুন্নাহার একটু বাইরে ছিলেন। খবর পেয়েই দৌড়ে এলেন। বাড়িতে বিদ্যুৎ রয়েছে। বৈদ্যুতিক পাখা রয়েছে কিন্তু তিনি কথা বলার জন্য বাড়ির সঙ্গে বেড়ে ওঠা একটি আশ্বিনা আমগাছের নিচের বসার জায়গা দিলেন। গাছের চারপাশে ছবির মতো আম ঝুলে রয়েছে। একটি ডাল প্রায় বাড়ির দেউড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে। রাস্তা থেকে তাকিয়ে দেখলে মনে হয় একটা বাগানবাড়ি।
ফাঁকা মাঠের মধ্যে বাড়িতে শিশুসন্তানদের নিয়ে থেকেছেন। আপনার অনেক সাহস। এই মন্তব্য করতেই নূরুন্নাহার বলেন, তাঁর কোনো সাহস নেই। প্রতিটা রাত আসত আর তাঁর মনে হতো, এই রাত আর ভোর হবে না। চারদিক থেকে দুর্ভাবনা ঘিরে আসত। রাতে ভয়ে শিশুদের ঘরেই প্রস্রাব-পায়খানার ব্যবস্থা করেছেন। শুধু শাশুড়ির সাহসে বাড়িটা ছেড়ে যাননি।
এখন নূরুন্নাহারের বাড়ির সঙ্গে সাড়ে তিন বিঘার একটি আমবাগান। বাড়ির দক্ষিণ পাশে বাগানের মাঝখানে একটি টংঘর। ছোট নাতি নাইম হোসেনকে সঙ্গে করে মাঝেমধ্যে টঙে গিয়ে বসেন। সেখানে বসে থাকতে ভালো লাগে।
ছেলে কামাল হোসেন বলেন, তাঁর আম পাহারা দেওয়ার কোনো দরকার পড়ে না। কেউ তাঁর বাগানে হাত দেয় না। এমনি শখ করে গত বছর টং পাতা হয়েছিল। কামাল হোসেনের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে নাসিম হোসেন এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। অবসরে বাবার দোকানে বসে। মেয়ে সুমাইয়া খাতুন নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে নাইম হোসেন তৃতীয় শ্রেণিতে।
নূরুন্নাহার বলেন, আমবাগানের কল্যাণেই এদের মানুষ করতে পারছেন। তিনি চেয়েছিলেন কামাল যত দূর পারে তিনি পড়াবেন কিন্তু ছেলে পড়েনি। এখন কামালের ছেলেমেয়েরা যত দূর পারে তিনি পড়াবেন। মেয়েটাকেও আগেভাগেই বিয়ে দিতে চান না।