মহিলা বাসের দেখা মেলে না

মহিলা বাস সার্ভিসের সাইনবোর্ড টাঙানো, তবে বাসের দেখা মেলে না। মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির কাছ থেকে তোলা ছবি। ছবি: মানসুরা হোসাইন
মহিলা বাস সার্ভিসের সাইনবোর্ড টাঙানো, তবে বাসের দেখা মেলে না। মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির কাছ থেকে তোলা ছবি। ছবি: মানসুরা হোসাইন

সড়কে কাজ হচ্ছে বলে লোহার রডে বসানো সাইনবোর্ডটি ফুটপাতের ওপরে রাখা। সাইনবোর্ডে লেখা ‘মহিলা বাস সার্ভিস স্ট্যান্ড’। কিন্তু সেখানে মহিলাদের কোনো বাসের দেখা নেই। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটির কাছে এ বাসস্ট্যান্ড। সম্প্রতি ওই বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে এবং লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাইনবোর্ড সর্বস্ব এই বাসস্ট্যান্ড রয়েছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে এই বাস সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) টাঙানো ওই সাইনবোর্ডের পাশে বসে পান-সিগারেট বিক্রি করছিলেন একজন। তাঁর ভাষ্য, গত ছয় মাসেরও বেশি সময়ের মধ্যে তিনি মাত্র একদিন বাসের চেহারা দেখেছেন। কাছে দাঁড়ানো কয়েকজন অটোরিকশা চালকও একই কথা বলেন।

বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের দাবি, মোহাম্মদপুরের এ বাস সার্ভিসসহ রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কপথে মোট ১৬টি বাস নারীদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। তবে মোহাম্মদপুর, প্রেসক্লাবসহ কয়েকটি এলাকার কর্মজীবী নারীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁরা দাবি করেন, ‘কালেভদ্রে’ তাঁরা এই বাসের চেহারা দেখেন। কেউ কেউ মহিলা বাসের জন্য অপেক্ষায় থেকে পরে অন্য যানবাহনে গন্তব্যে পৌঁছান। নারী যাত্রীদের মতে, রাজধানীতে কর্মজীবী নারীর তুলনায় মাত্র ১৬টি বাসের সংখ্যাটি খুব কম।

সম্প্রতি বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাকে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটায় নগরের নারী যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। যাঁরা এত দিন পাবলিক বাসকে নিরাপদ মনে করতেন, তাঁরা এখন আর ততটা নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। অনেকের পক্ষে দ্বিগুণ, তিনগুণ ভাড়া খরচ করে ট্যাক্সিক্যাব, সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করারও সামর্থ্য নেই।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকশনএইড বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০টি দেশে ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয় নারী’ প্রচারণার উদ্বোধন করে ২০ মে। এর একদিন পরই ২১ মে রাতে রাজধানীতে কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে এক আদিবাসী তরুণীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে একদল দুর্বৃত্ত। ওই তরুণী যমুনা ফিউচার পার্কে একটি পোশাকের দোকানে কাজ করেন। কাজ শেষে যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে উত্তরার বাসায় যেতে বাসের জন্য একটি সিএনজি স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।

এ ঘটনার কিছুদিন আগে ময়মনসিংহের ত্রিশালে একজন গৃহকর্মীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান বাসচালক। ওই নারী বাস থেকে লাফ দেন। পরে এলাকাবাসী বাসচালককে আটক করে পুলিশে দেন। আরেকটি ঘটনায় ট্রাকের মধ্যেও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রযেছে। এরও আগে মানিকগঞ্জে ১৭ বছর বয়সী এক পোশাক-কর্মীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান বাসচালক ও তাঁর সহকারী। এসব ঘটনায় গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। 

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ‘নিরাপদ নগর কর্মসূচির ভিত্তিমূলক জরিপে’ গণপরিবহনে যৌন হয়রানি ঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নারীরা গণপরিবহনসহ বিভিন্ন জায়গায় যৌন হয়রানির শিকার হন। ৪৮ শতাংশ নারীর বাসের চালক বা ভাড়া আদায়কারীর মুখে অবমাননাকর ভাষা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যৌন হয়রানি বা সহিংসতা এড়াতে কৌশল হিসেবে জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের ১৩ শতাংশ গণপরিবহন ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন বলেও জানান। তিন শতাংশ নারী বলেন, আত্মরক্ষায় তাঁরা অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখেন। ২০১৪ সালের মধ্য মে থেকে মধ্য জুনের মধ্যে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ৮০০ নারী ও কিশোরী এবং ৪০০ পুরুষের (এর মধ্যে ২০০ জনের বয়স ১৮ বছরের কম) সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।

বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিসের নারী সহকারী পুরুষ যাত্রী তুলছেন। ছবিটি গত বছরের মাঝামাঝি তোলা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন।
বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিসের নারী সহকারী পুরুষ যাত্রী তুলছেন। ছবিটি গত বছরের মাঝামাঝি তোলা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন।

গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির চিত্র নতুন নয়। নাম প্রকাশ না করে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত একজন নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হিসেবে সব সময় ট্যাক্সিক্যাব বা সিএনজি অটোরিকশায় যাতায়াত করতে পারি না। সব অফিস নারী কর্মীদের যাতায়াতের জন্য পরিবহনও দেয় না। সে ক্ষেত্রে গণপরিবহনই ভরসা।’ বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিস সম্পর্কে এই নারী বলেন, ‘অনেক দিন আগে রাস্তায় একটি মহিলা বাস দেখেছিলাম।’

গণপরিবহনে যৌন হয়রানি প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নারী বলেন, ‘বাসে উঠতে এবং নামতে হেলপারের হাত শরীরের পেছন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংশে গিয়ে লাগে। কিছু পুরুষ যাত্রী ইচ্ছা করে গায়ের ওপরে পড়ে যান। এসব ধরলে এই জীবনে কতবার যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছি, তা হিসাব করে বলা অসম্ভব।’ এ ছাড়া বিআরটিসি বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ করা সিটে পুরুষ বসে থাকেন, অন্যান্য বাসে নারী যাত্রীর জন্য বরাদ্দ হয় চালকের পাশে ইঞ্জিনের ওপরে, নারী যাত্রীদের বাসে সিট নেই অজুহাতে না তোলাসহ অন্যান্য হয়রানি তো আছেই।
এই নারীরা তাঁদের অভিজ্ঞতায় আলাদা মহিলা বাস সার্ভিস থাকলে ‘ভালোই হয়’ বলে মন্তব্য করেন। এ ধরনের বাসের যাত্রী নারী, বাসের সহকারীও নারী। তবে বাসের সংখ্যা না বাড়ানো হলে নারীদের সমস্যা না কমে বরং বাড়বে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিআরটিসির মহিলা বাসের সংখ্যা যে কম, তা স্বীকারও করলেন বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আলমাস আলী। তিনি জানালেন, অফিস সময় অনুযায়ী সকালে এবং বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে ১৬টি বাস চলাচল করছে। কিছু বাস ৫২ সিটের, কিছু বাস ৭৪ সিটের। তবে রাস্তায় যানজটের কারণে বাসগুলো ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারে না বলেও তিনি জানান।

বিআরটিসি মহিলা বাসে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী যাত্রী। ছবিটি গত কাল তোলা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বিআরটিসি মহিলা বাসে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী যাত্রী। ছবিটি গত কাল তোলা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাস সার্ভিসের বেহাল অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিলে আলমাস আলী প্রথমে তা মানতে রাজি হননি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সঠিক নয় বলেও উল্লেখ করেন। পরে ওই সড়কপথের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদককে বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সার্ভিসটি ‘‘দুই দিন’’ ধরে বন্ধ আছে।’ |

আলমাস আলী বলেন, ‘বলতে গেলে এ সার্ভিস চালাতে ক্ষতিই হচ্ছে। খরচটা উঠে কোনো রকমে। কিছু রুটে যাত্রী পাওয়া যায়, আবার কিছু রুটে পাওয়া যায় না। একবেলা যাত্রী পাওয়া গেলে আরেক বেলা পাওয়া যায় না। তাই এ সার্ভিস চালাতে হলে নারীদেরও উৎসাহী হতে হবে।’

গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে রয়টার্সের বরাতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালা চালু করে ‘শি ট্যাক্সি’। গোলাপি রঙের ৪০টি ট্যাক্সি, যার সব কয়টির চালকই নারী। এসব ট্যাক্সিতে রয়েছে গতিবিধি শনাক্ত করার যন্ত্র ও একটি বিশেষ বাটন, যা কল সেন্টারগুলোর সঙ্গে যুক্ত। এর মাধ্যমে ট্যাক্সিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

রাজধানী ঢাকায় এভাবেই পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীদের বাসে উঠতে ও নামতে হয়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
রাজধানী ঢাকায় এভাবেই পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীদের বাসে উঠতে ও নামতে হয়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন