ঝুঁকি না নিলে পিছিয়ে পড়তে হয়

ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ
ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ

ফেসবুকের সৃষ্টি হয়েছিল শুধু একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, আমাদের একটি সামাজিক উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া, মানুষকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসা। ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে এই উদ্দেশ্যটি বুঝতে হবে, জানতে হবে আমরা কী করি, কেনই বা করি। এই চিঠিতে আমি সে কথা জানাব।
বর্তমানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক সুতোয় গেঁথে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার এক বিশাল চাহিদা ও সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। সবাইকে নিজের স্থান থেকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে তা গোটা সমাজব্যবস্থাকেই বদলে দেবে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও গভীর হবে। যতই উচ্চাভিলাষী মনে হোক না কেন, অনেক বড় কিছুর শুরুও ছোট্ট একটি পদক্ষেপ থেকেই হয়।
মানুষের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুতোগুলোই আমাদের নতুন আইডিয়া খুঁজে দেয়, চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বুঝতে সাহায্য করে, আমাদের জীবনকে ভরিয়ে তোলে। ফেসবুক মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তাকে অন্যদের সঙ্গে সংযুক্ত করে, পারস্পরিক তথ্য ও ভাব আদান-প্রদানের সুযোগ করে দেয়। সর্বোপরি নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলে, একই সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে।
শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কই নয়, আমরা আশা করি এই বিস্তৃত সম্পর্কের জাল ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করবে। এই নিত্যনতুন সম্পর্কের ফলে অসংখ্য নতুন পণ্য ও সেবার সৃষ্টি হবে, যা মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করবে বহুগুণে। আমরা ইতিমধ্যে গেমস, সংগীত ও সংবাদশিল্পে ফেসবুকের উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখেছি। সামনের দিনগুলোতে এমন আরও অনেক শিল্পকে আমরা নতুন আঙ্গিকে দেখতে চাই, যা সরাসরি সমাজব্যবস্থাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আমরা ফেসবুকে এক ভিন্নধর্মী কাজের ধারার প্রচলন করেছি, একে বলা হয় ‘হ্যাকার ওয়ে’। সাধারণত ‘হ্যাকার’ শব্দটিকে সবাই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে। আসলে এর শাব্দিক অর্থ খুব দ্রুত কিছু তৈরি করা বা কোনো কিছুর সম্ভাবনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা আরও কী করা যেতে পারে। হ্যাকার ওয়ে বলতে আমরা বোঝাই কোনো কাজে সার্বক্ষণিক উন্নতি করা ও প্রয়োজন হওয়ামাত্রই পরিবর্তন আনা। আমাদের হ্যাকাররা বিশ্বাস করে একটি কাজকে সব সময়ই আরও ভালো, আরও নিখুঁত করে তোলার সুযোগ থাকে। কাজ কখনো পাকাপাকিভাবে শেষ হবে না। সেজন্য আত্মতুষ্টি পরিহার করে কোনো কাজকে প্রতিনিয়ত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে কোনো কাজ খুব কঠিন হলেও সেটিকে অসম্ভব দাবি করে বসে থাকা যাবে না। অনেক বছর সময় নিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ একটি জিনিস তৈরির পরিকল্পনা না করে, তারা প্রতিনিয়ত ছোট ছোট পরিবর্তন আনতে থাকে এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। অফিসের দেয়ালে আমরা বড় বড় অক্ষরে লিখে রেখেছি, ‘শতভাগ নিখুঁত কিন্তু অসমাপ্ত কাজের চেয়ে কিছু ভুলত্রুটিসহ একটি সমাপ্ত কাজ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’
একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা পাঁচটি নীতির ওপর ভিত্তি করে চলি: ১. সম্ভাব্য ফলাফলের ওপর মনোযোগ দাও: যদি তুমি সত্যি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চাও, তাহলে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো খুঁজে বের করা। এটা শুনতে জলের মতো সহজ মনে হলেও বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ কাজটি সুষ্ঠুভাবে করতে ব্যর্থ হয়। ফেসবুকে আমরা সবার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি যে তারা কাজ করার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোকেই বেছে নেবে।
২. দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাও: দ্রুতগতিতে কাজ করায় আমরা বেশি কাজ করতে পারি আর খুব তাড়াতাড়ি নতুন জিনিস শিখেও নিতে পারি। সাধারণত, একটি প্রতিষ্ঠান যত বড় হয়, সেখানে নতুন আইডিয়া গ্রহণ করা বা শেখার গতিও তত কমে আসে। কারণ, তারা সব রকম ভুল এড়িয়ে চলতে চায়, নতুন সম্ভাবনাকে দমিয়ে রেখে হলেও তারা নিজেদের কাজে যথাসম্ভব নির্ভুল থাকতে চায়। আমরা বলি, ‘সবকিছু ভেঙেচুরে হলেও দ্রুত এগিয়ে চলো।’ যদি কিছু না-ই ভাঙল, তাহলে সম্ভবত তুমি যথেষ্ট দ্রুত এগিয়ে চলছ না।
৩. দৃঢ়চেতা হও: বড় কিছু করতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে। এটি সহজ কাজ নয়, অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা উচিত হলেও করে না। কিন্তু পৃথিবী যেভাবে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে, ঝুঁকি না নিয়ে সব সময় নিরাপদে থাকতে চাইলে পিছিয়ে পড়তে হবে। আমরা বরং বলি, ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে কোনো ঝুঁকিই না নেওয়া।’ আমরা সবাইকে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ দিই। মাঝেমধ্যে ভুলত্রুটি হতে পারে, হলোই না হয়!
৪. মনকে উদার করে তোলো: আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবীর তথ্যভান্ডার যত উন্মুক্ত হবে, মানুষ তত উন্নতি করবে। অধিকতর তথ্য পাওয়ার ফলে মানুষ আরও সহজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং সমাজে তার প্রভাব পড়বে। প্রতিষ্ঠান চালানোর ব্যাপারেও আমরা এই নীতি অনুসরণ করি। ফেসবুকে কর্মরত সবার কাছে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য যতটা সম্ভব উন্মুক্ত রাখা হয়। এতে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে ও প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে অধিকতর অবদান রাখতে পারে।

৫. সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করো: ফেসবুকের লক্ষ্য পৃথিবীকে আরও উন্মুক্ত করা, মানুষের একে অপরের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ সৃষ্টি করা। শুধু ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন করা নয়, আমরা সবাই খেয়াল রাখি প্রতিদিনের কাজের মাধ্যমে আমরা কীভাবে সমাজব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারি, পৃথিবীকে কিছু দিতে পারি।

এই চিঠি পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীকে কিছু দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা আমাদের আছে। আমি আশা করি, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারব।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ অনলাইন সংস্করণ। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত

অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার