ছাত্রীদের 'কমন' সমস্যা

ঘরটি অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঘরের সব বাতি জ্বালিয়ে আর সব কটি জানালা খুলে দিয়েও অন্ধকার দূর হচ্ছে না। কাঠ আর বোর্ডের কয়েকটি টেবিল ছড়ানো-ছিটানো। কোনোটার পায়া হেলে গিয়েছে, কোনোটার কোনা ভাঙা, কোনোটা ঘুণপোকায় ভঙ্গুরপ্রায়। চেয়ারগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের কমনরুমের চিত্র হলো এটা। বেশি শোচনীয় অবস্থা কমনরুমের টয়লেট।

ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মেয়েদের কমনরুমে এই দৃশ্যের দেখা মিলবে। কয়েক দিন আগে ভাদ্রের এক দুপুরে ঘুরে ঘুরে দেখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমনরুমগুলো। কলা ভবনে নিচতলা আর চারতলার দুটি কমনরুম দেখা হলো। এরপর ঢুঁ মারা হলো ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, আইন অনুষদ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্রীদের কমনরুমে। কথা হয় ছাত্রীদের সঙ্গে। তাঁরা জানিয়েছেন তাঁদের কমন কিছু সমস্যার কথা।

কলা ভবনে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ২৮টি বিভাগের ছাত্রীদের জন্য রয়েছে মাত্র দুটি কমনরুম। নিচতলায় ৫০ আর চারতলায় ৬০ জন ছাত্রীর বসার ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। এ জন্য ক্লাসের ফাঁকের সময়টুকু কাটাতে ছাত্রীদের ঠাঁই নিতে হয় করিডর, ভবনের সামনের ফাঁকা জায়গা কিংবা টিএসসিতে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় পরীক্ষার সময়। জায়গার সংকট আর অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কোনোভাবেই কমনরুমে পড়াশোনা করা সম্ভব নয় বলে জানান অনেক ছাত্রী।

কমনরুমের টয়লেটের অবস্থা আরও খারাপ। কলা ভবনের নিচতলায় কমনরুমের সঙ্গে পাঁচটি এবং চারতলার কমনরুমে দুটি টয়লেট আছে, যা ছাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। ফলে টয়লেটে যেতে ছাত্রীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, অনেক সময় লাইন ধরতে হয়। এ ছাড়া টয়লেটগুলো দুর্গন্ধ, নোংরা, ময়লায় পরিপূর্ণ, একটার কল দিয়ে আবার সব সময় পানি ঝরছে। টয়লেটের সামনের জায়গাও কাদা-পানি দিয়ে মাখামাখি হয়ে থাকে সব সময়। তাই দীর্ঘ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও ছাত্রীরা টয়লেটে যেতে চান না।

ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তানজিনা আহমেদ বলেন, ‘টয়লেট এত নোংরা আর গন্ধ, কত দিন টয়লেটের সামনে গিয়েও ফিরে এসেছি।’ ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সাজিয়া আফরিনও বললেন একই রকম কথা, ‘একে তো নোংরা, তার ওপর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় বলে টয়লেটে যাই না।’

ছাত্রীদের এসব অভিযোগের কথা জানানো হলে নিচতলার কমনরুমের তত্ত্বাবধানকারী আছিয়া খাতুন বলেন, ‘অতিরিক্ত শিক্ষার্থী আর মেয়েদের অবহেলার জন্যই টয়লেটের এমন অবস্থা। আর চেয়ার-টেবিল কর্তৃপক্ষ না দিলে আমি কী করব।’ আইন বিভাগের কমনরুমে মাত্র দুটি টয়লেট আছে। টয়লেটে নতুন করে টাইলস বসানো হলেও অপরিষ্কার। আইন বিভাগের ছাত্রী স্নিগ্ধা রায় বলেন, ‘টয়লেটের অবস্থা বাজে। দুই বছরে একবার গিয়েছি। ভার্সিটিতে যতক্ষণ থাকি, টয়লেটে যাই না। খুব দরকার হলে অন্য অনুষদের টয়লেটে যাই।’

সরেজমিনে দেখা যায়, কমনরুমের টয়লেট অপরিচ্ছন্ন বলে ছাত্রীরা তেমন ব্যবহার করেন না।  এতে দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক রেজওয়ানুল হক রব্বানী বলেন, দীর্ঘ সময় প্রস্রাব আটকে রাখলে মূত্রথলি বড় হয়ে যায়। এতে পূর্ণভাবে প্রস্রাব না হওয়ায় নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। ফলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, তলপেট বা কোমরে ব্যথা, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে জ্বর আসতে পারে। এ ছাড়া এতে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

খাবার নিয়েও কম সমস্যা পোহাতে হয় না ছাত্রীদের। আইন অনুষদের কমনরুমে খাবারের ব্যবস্থা নেই। শুধু কমনরুম কেন, পুরো আইন অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্যই খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবে কমনরুমে না হলেও আইন অনুষদে খাবারের ব্যবস্থা অবশ্যই রাখা উচিত, বলেন আইন বিভাগের ছাত্রী আরিফা চৌধুরী। কলা ভবনের কমনরুমে খাবার থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়, এমনকি স্বাস্থ্যকরও নয় বলেও দাবি ছাত্রীদের। তবে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে খাবারের ব্যবস্থা ভালো হলেও দাম বেশি। এ ছাড়া শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এ কমনরুমে চমৎকার বসার ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাও অন্য অনুষদের চেয়ে বেশি। 

 কার্জন হলের বিজ্ঞান অনুষদের কমনরুমগুলোতে খাবারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ক্লাস হয় মোকাররম হোসেন খন্দকার বিজ্ঞান ভবনে। সেখানে কোনো কমনরুমই নেই। এসব সমস্যা সম্পর্কে অবহিত আছেন বলে জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত কলা ভবনের কমনরুমে চেয়ারের ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া আইন অনুষদে ক্যানটিন চালু করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টিও দেখা হবে।