জীবনের নতুন ঘাটে

বেদে সম্প্রদায়ের এই তরুণদের কেউ কেউ এরই মধ্যে গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ছবি: খালেদ সরকার
বেদে সম্প্রদায়ের এই তরুণদের কেউ কেউ এরই মধ্যে গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ছবি: খালেদ সরকার

‘যত বেশি গতি, তত বেশি ক্ষতি’—পদার্থবিদেরা না মানলেও একজন পরিসংখ্যানবিদের দ্বিমত করার সুযোগ নেই। গত এক বছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সিংহভাগের পেছনের কারণ চালকের অজ্ঞতা, তাঁদের একগুঁয়েমি। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাঁদের একরোখা ড্রাইভিং। বেরিয়ে আসার উপায়? প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ চালক তৈরি। তবে নিরাপদ সড়কের কথায় পরে আসছি। তার আগে একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক।
ঢাকা জেলার সাভারে বেদেপল্লির গোড়াপত্তন কবে, তা ইতিহাসবেত্তার ভাবনার বিষয় হতে পারে। তবে বর্তমান প্রজন্মের বাপ-দাদার ভিটা এখানে। ভিটা এ জন্য বলছি, নৌকায় নৌকায় তাঁদের যাযাবর জীবনের ইতি বেশ আগেই। জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে। তারা খুঁটি গেড়ে বসেছে। এরপর তাদের সাপের খেলা দেখানো, দাঁতের ‘পোকা’ ফেলা, তাবিজ-কবজ দেওয়া, শিঙা ফুঁকে বাতের ব্যথার নিরাময় চলতে থাকে বেশ। শহরে-বন্দরে, গ্রামেগঞ্জে। ধীরে ধীরে মানুষ আধুনিক হতে শুরু করে, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে। সাপের খেলা যে নিছক এক প্রদর্শনী আর বাকি সব যে স্রেফ ফাঁকিবাজি, তা বুঝতে কারও বাকি থাকে না। মানুষ হারায় আগ্রহ, আর বেদেরা হারায় তাদের পরম্পরায় চলে আসা জীবিকা নির্বাহের পথ। অগত্যা ভিন্ন পেশার খোঁজে নেমে পড়া।
তারা যে বেদে! সবার চোখে তাদের ভিন্ন সমাজ, ভিন্ন পল্লি, তারা ভিন্ন জাতের মানুষ! স্রোতের সঙ্গে মিশতে পারেনি, কিংবা স্রোত তাদের মিশতে দেয়নি। শুরু হয় মাদকের ব্যবসা। বেদেপল্লি হয়ে ওঠে মাদকপল্লি! শহরের বিভিন্ন এলাকায় এই পল্লি থেকেই মাদক সরবরাহ হতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয় পুলিশের তৎপরতা। কিন্তু নানা কারণে এই পল্লির ভেতরে গিয়ে বেদেদের ধরে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ হয়নি তাদের। এ সময়ে সাভারে আসেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) হাবিবুর রহমান। তিনি সমস্যার কথা বুঝতে পেরে বেছে নেন ভিন্ন পথ। কাউকে শাস্তি না দিয়ে বরং সরদারসহ বেদেদের আমন্ত্রণ জানান এক আলোচনা সভায়। বেদেরা আসে, আলোচনায় অংশ নেয়। স্বীকার করে নেয় নিজেদের দোষ। সমাজে মিশে সহজ-স্বাভাবিক পেশা বেছে নিতে পারছে না বলেও অকপটে স্বীকার করেন বেদে সরদার। তাঁদের এই স্বীকারোক্তি হাবিবুর রহমানের যেমন ভালো লাগে, তেমনই বেদেদের সমস্যাও তাঁকে বেশ ভাবিয়ে তোলে।
বেদেরা জানান, স্বাভাবিক পেশা, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারলে মাদক ব্যবসা তাঁরা ছেড়ে দেবেন। হাবিবুর রহমান তাঁর অধস্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে লেগে পড়েন এই বেদেদের স্বাভাবিক পেশায় নিয়ে যেতে। শুরু হয় তাঁর বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ। এগিয়ে আসে ব্র্যাক। পুলিশের সহায়তায় তারা বেদে সম্প্রদায়কে ভিন্ন পেশার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে।

সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বেদে সম্প্রদায়ের কয়েক নারী
সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বেদে সম্প্রদায়ের কয়েক নারী

বংশী নদীর পারে পোড়াবাড়ি, আমলপুর ও কাঞ্চনপুর—এই তিনটি গ্রাম নিয়ে সাভারের বেদেপল্লি। হাজার বিশেক মানুষের বাস। শিক্ষার নিম্নহার এই অঞ্চলের মানুষের পিছিয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ বলে মনে করেন কিছু তরুণ। এই তরুণেরাই ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পোড়াবাড়ি সমাজকল্যাণ সংঘ। সাভার মডেল থানার সঙ্গে কাজ করছেন এই সমাজকল্যাণ সংঘের তরুণেরা। শুরুটা শিক্ষার হার বাড়ানো দিয়ে।
১৫ অক্টোবর সকালে বেদেপল্লিতে গিয়ে কথা হয় একদল তরুণের সঙ্গে। তাঁদের অনেকেই অংশ নেবেন বিনা মূল্যে গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণে। প্রাথমিকভাবে ১২ জন, তবে পরবর্তী সময়ে আরও অনেকে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন। বেদে পরিবারে সাধারণত নারীরা আয় করতেন বেশি। এখনো তাঁরা পিছিয়ে নেই। এগিয়ে আসেন এক পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানের মালিক নানজিবা নাজনিন। বেদে সম্প্রদায়ের ১০৫ জন মেয়েকে সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন, সেলাই মেশিন কিনে দেন তিনি। বেদেপল্লির কাছেই স্থাপন করেন তাঁর তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার একটি শাখা। সেখানে কথা হয় মুমিনা বেগম ও লিমা বেগমের সঙ্গে। বেদে সম্প্রদায়ের এই দুই নারী আগে সাপখেলা দেখাতেন। এখন আয় বেড়েছে, শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নতুন জীবনে তাঁরা বেশ আনন্দিত। সুপারভাইজার মোসাম্মাত তসলিমা জানান, দামি পোশাক তৈরিতে আয় বেশি। এখন তাঁদের দিনে সব মিলিয়ে প্রত্যেকের তিন থেকে চার শ টাকা থাকছে।
১০ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশ ও ব্র্যাকের যৌথ আয়োজনে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ ও বেদেদের অন্য পেশায় নেওয়ার যে উদ্যোগ, তার উদ্বোধন করা হয়। সেখানে মিলনায়তনের এক দেয়ালে লেখা ছিল, ‘যত বেশি গতি/ তত বেশি ক্ষতি’। গতি নিয়ন্ত্রণে রেখে এগিয়ে যাওয়া যায় জীবনে। বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যদের সেটুকু গতি এনে দিতে পারলে ক্ষতি কী!