হাসি-কান্না-আড্ডায় সাফল্যের গল্প

‘আমার কাজ, আমাদের অর্জন’ শীর্ষক নারীদের মিলনমেলায় নিজেদের সাফল্যগাথা শোনাচ্ছেন এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী মাবিয়া আক্তার (ডানে) ও মাহফুজা খাতুন
‘আমার কাজ, আমাদের অর্জন’ শীর্ষক নারীদের মিলনমেলায় নিজেদের সাফল্যগাথা শোনাচ্ছেন এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী মাবিয়া আক্তার (ডানে) ও মাহফুজা খাতুন

তরুণ প্রজন্মের নারীরা শোনালেন তাঁদের বিজয়ের কথা, জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার কথা। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এই নারীরা এগিয়ে চলেছেন তাঁদের নিজ গন্তব্যে। স্বপ্ন তাঁদের আরও বড়। যেতে চান বহুদূরে। এসব নারীর এগিয়ে চলার গল্পে আবেগাপ্লুত নানা শ্রেণি-পেশার সফল নারীরাও। তাঁরাও বললেন, এঁরাই আমাদের নায়িকা, এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা।

অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন কিরণ চন্দ্র রায় ও চন্দনা মজুমদার
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন কিরণ চন্দ্র রায় ও চন্দনা মজুমদার

গতকাল সোমবার ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন মিলনায়তনে বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু হয় প্রথম আলো আয়োজিত নারী দিবসের অনুষ্ঠান। এবারের আয়োজনের বিষয় ছিল ‘আমার কাজ, আমাদের অর্জন’। সেই অনুষ্ঠানে কলসিন্দুরের মেয়েরা, সাফ গেমসে সোনা বিজয়ী দুই নারী আর ভারতে নির্যাতিত আয়শা সিদ্দিকা শোনালেন জীবনযুদ্ধের কথা। সফলতার কথা। সেখানে আরও এসেছিলেন নানা শ্রেণি-পেশার সফল নারীরা। তারুণ্যের বিজয়ের কথা শুনে কখনো অতিথিরা হেসেছেন, কখনো কেঁদেছেন। হাসি-কান্না-আড্ডায় সফলতার গল্প শুনেছেন তাঁরা।
কলসিন্দুর গ্রামের দুই ফুটবলার সানজিদা ও মারিয়া জানাল তাদের কথা। কতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তারা দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে, সেই বর্ণনা ছিল তাদের সহজ-সরল ভাষায়। তারা বলল, ভালো খেলে তারা দেশকে ও নিজেদের অনেক দূর নিয়ে যেতে চায়। তাদের স্কুলের শিক্ষক মিনতি রানী সাহা গ্রামের মেয়েদের জন্য সবার সহযোগিতা চান।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম কুড়ানো ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের নারী ফুটবলাররাও এসেছিলেন। সঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী সাহা
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম কুড়ানো ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের নারী ফুটবলাররাও এসেছিলেন। সঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী সাহা

ভারোত্তোলনে সোনাজয়ী মাবিয়া আক্তার আর সাঁতারে দুটি সোনা বিজয়ী মাহফুজা খাতুন শোনালেন তাঁদের কথা, এগিয়ে যাওয়ার কথা। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সোনা বিজয়ী মাবিয়ার কান্নার সেই ভিডিও ফুটেজ বিমোহিত করে অনুষ্ঠানে আসা সবাইকে। সবাই দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জানান এই দুই নারীকে। জবাবে তাঁরা দুজনই ভবিষ্যতে অলিম্পিকসহ বড় আসরে বাংলাদেশের সম্মান আরও বাড়ানোর জন্য কাজ করবেন বলে জানান।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান আয়শা সিদ্দিকার জীবনযুদ্ধে জয়ের কথা বলেন। তাঁর লেখা নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া বইয়ের একটি কপি হাতে তুলে দেন মতিউর রহমান। তিনি আয়শার লেখা একটি কবিতাও পড়ে শোনান। আয়শা সিদ্দিকা শোনান ভারতে যাওয়া, আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা আর নির্যাতনের ঘটনা। সেখান থেকে কৌশলে বেরিয়ে আসা, বই লেখা, ছবি আঁকা, কবিতা লেখাসহ বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। এ সময় তাঁর পাশে স্বামী সারাফাত হোসেন আর মঞ্চের সামনে ছিলেন তিন মেয়ে। আয়শার বর্ণনা শুনে আবেগাপ্লুত হন সবাই। তবে তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা সবাইকে অনুপ্রাণিত করে।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে আসা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানো হয়। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয় জাতীয় অধ্যাপক চিকিৎসক শাহলা খাতুন, জাতিসংঘের সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান, ইত্তেফাক-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী, সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন, নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুশফেকা ইকফাৎ​ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে।

ভারতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার আয়শা সিদ্দিকা তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শোনান। এ সময় পাশে ছিলেন স্বামী শারাফাত হোসেন
ভারতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার আয়শা সিদ্দিকা তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শোনান। এ সময় পাশে ছিলেন স্বামী শারাফাত হোসেন



অনুষ্ঠানে আসা বিভিন্ন ক্ষেত্রের সফল নারীরা বললেন, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কেউই এগোতে পারবে না। কোনো উন্নয়নও স্থিতিশীল হবে না। নারী-পুরুষকে একসঙ্গে চলতে হবে। যার যা প্রতিভা, সেটা বিকশিত হতে একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। দুজনে সমান না হলে কেউই টিকে থাকতে পারবে না।
অনুষ্ঠানের শুরুতে তিন ভাইবোন স্বাগতা, সভ্যতা আর সন্ধির গাওয়া ‘আমরা করব জয়’ গানটির সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন সবাই। সবাই মিলে বিজয়ী হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। জয়ের প্রত্যয় নিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটির সমাপ্তিও হয় জয়ী হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে।
শুরুতে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন। তিনি বলেন, একটি অর্জন কেবল একজনের নয়। অর্জন সবার। তিনি বলেন, এখন আর নারী ক্রিকেটার বা নারী ডাক্তার বলার দরকার হয় না। এখন কেবল ক্রিকেটার বা চিকিৎসক বললেই হয়।
সাবেক খাদ্যসচিব ও ট্যারিফ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মুশফেকা ইকফাৎ​ বলেন, মেয়েদের অর্জনের পথটা সহজ ছিল না। তাঁদের ব্যাচের নারীরাই প্রথম জেলা প্রশাসক ও সচিব হয়েছেন। এখন তো অনেকেই বড় পদে যাচ্ছেন।

শাহলা খাতুন বললেন, নারীরা একা উঠে আসতে পারবে না। তাদের বাবা, ভাই ও বন্ধুদের সহযোগিতা লাগবে। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই নারী-পুরুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মার্শা বার্নিকাট বলেন, নারী-পুরুষকে হাতে হাত রেখে এগোতে হবে। আলাদা করে কিছু হবে না। এখানে সবাই সবার গাইড।

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন গানের কিছু অংশ গেয়ে শোনান। নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, নাচ করার কারণে কোনো নারীকেই যেন নিগৃহীত হতে না হয়, সেটাই চাওয়া।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, নারীরা নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রথম আলো এই এগিয়ে চলার সঙ্গে সব সময়ই থাকবে। তিনি বলেন, আয়শাসহ আরও যাঁরা নিজেদের কথা বললেন, এমন অসংখ্য বাধা পেরোনোর ঘটনা নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাবে।

অনুষ্ঠানের শেষে গান গেয়ে শোনান কিরণ চন্দ্র রায় ও চন্দনা মজুমদার। তাঁদের গানের মধ্য দিয়েই শেষ হয় প্রথম আলোরনারী দিবসের অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে ‘আমরা করব জয়’ গানটি গেয়ে শোনান তিন ভাইবোন স্বাগতা, সন্ধি ও সভ্যতা। ভায়োলিন বাজান নাদিয়া
অনুষ্ঠানে ‘আমরা করব জয়’ গানটি গেয়ে শোনান তিন ভাইবোন স্বাগতা, সন্ধি ও সভ্যতা। ভায়োলিন বাজান নাদিয়া