ওষুধ বিনিময়ের ফার্মেসি

গ্রামের অনেক মানুষই বিনা মূল্যে ওষুধ পাচ্ছে। ছবি: লেখক
গ্রামের অনেক মানুষই বিনা মূল্যে ওষুধ পাচ্ছে। ছবি: লেখক
সবারই কিছু না কিছু ওষুধ বেঁচে যায়। সেগুলো ফেলে না দিয়ে এক জায়গায় জমালে আরও বহু মানুষের কাজে লাগবে। এই সাদামাটা একটা ধারণা সেনেগালের এক প্রত্যন্ত গ্রামে স্বাস্থ্যসেবার চেহারা পাল্টে দিয়েছে।

রাজধানী ডাকার থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে মধ্য সেনেগালের প্রত্যন্ত গ্রাম পাসি। এই অধিবাসীরা নিজেদের একটা প্রকট সমস্যা নিজেরা সমাধান করে ফেলেছে বড় অভিনব উপায়ে।

গ্রামের ৭৫০ অধিবাসী জোক্কো সান্তের স্বাস্থ্যসেবা বিনিময় কর্মসূচিতে নাম লিখিয়েছেন। সেই থেকে ওষুধ সবার জন্য সহজলভ্য। আর এটা সম্ভব হয়েছে একটা সামষ্টিক ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। সদস্যরা তাঁদের বেঁচে যাওয়া ওষুধ জমা দেন এই ফার্মেসিতে। আর সে ওষুধ যাঁর দরকার, তাঁদের মধ্যে নতুনভাবে বণ্টন করে দেওয়া হয়। এর ফলে পাসির স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে নিয়মিত রোগী দেখানোর হারও অনেক বেড়ে গেছে।

সোমবার সকাল। সূর্য পাসির ওপরে ধীরে ধীরে উঠে আসছে। নারীরা পশুটানা অথবা মোটর-ট্যাক্সিতে চড়ে বাজারে যাচ্ছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের বাইরে ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে রোগীদের একটা সারি।

ওসমান দিয়ালো। লম্বা, ধূসর দাড়িওয়ালা মানুষটি শীতের সোয়েটার পরে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের বারোয়ারি ফার্মেসির দিকে হাঁটা দিয়েছেন। তাঁর হাতের বটুয়াতে বেঁচে যাওয়া কিছু ওষুধ।

‘গত বছর আমি দু-দুবার এই ফার্মেসির সদস্য হওয়ার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু সদস্য ফরম ছিল না বলে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আজ আমি নিজেই যাচ্ছি ওষুধ দান করতে।’ এই হলো দিয়ালোর কথা। যাঁদের খুব দরকার, তাঁরা তাঁর দেওয়া ওষুধ নিতে পারবেন এখন। ওসমান দিয়ালোও এভাবে ভবিষ্যতে এখান থেকে সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে ফেলছেন।

দিয়ামা এনদিয়াভে পাসি গ্রামের এই বারোয়ারি ফার্মেসির ম্যানেজার। তিনি বলছিলেন, ‘যাঁরা অসুস্থ ছিলেন, তাঁরা তাঁদের বাড়তি ওষুধ দান করার বিনিময়ে কিছু পয়েন্ট অর্জন করেন, যেগুলো জমা থাকে তাঁদের মোবাইল ফোনে। ভবিষ্যতে অসুস্থ হলে তখন তাঁরা এই পয়েন্টগুলোর বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। কারও যদি চিকিৎসা নেওয়ার মতো যথেষ্ট পয়েন্ট না থাকে, তাহলে অন্য কারও কাছ থেকে ধারও করা যায়। এ ছাড়া এ ফার্মেসিতে কোনো ওষুধ মজুত না থাকলে আমরা এসব পয়েন্ট দিয়ে বাণিজ্যিক ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে যাঁর দরকার তাঁকে দিই।’

আশ্বাসের নিশ্বাস

পাসির স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের করিডরে সদস্যরা এই ফার্মেসির সেবার বিষয়ে কথা বলেন। তারা উচ্ছ্বসিত। লামাইন সাইলা এক শীর্ণ শরীরের বৃদ্ধ মানুষ। তিনি প্রায়ই এখান থেকে ওষুধ নেন। ‘অতীতে, ডাক্তার বা নার্স আমার হাতে ওষুধের তালিকা ধরিয়ে দেওয়ার আগে আমি নিশ্চিত থাকতাম না যে আমি ওগুলো কিনতে পারব কি না। কিছু কিছু ওষুধের দাম আট হাজার সিএফএ ফ্রাঙ্ক (সেনেগালের সরকারি স্বাস্থ্যবিমার আওতার চেয়ে দামি)। আমার তখন ভাবতে হতো ওষুধ কিনব না খাবার কিনব।’ বলছিলেন লামাইন সাইলা। এই ফার্মেসি সাইলার সেই সংগ্রামের অবসান ঘটিয়েছে।

ফাতৌ দিয়বও এই উদ্যোগের খুব তারিফ করলেন। ‘আমার স্নায়বিক চাপের অসুখ ছিল, প্রতি মাসে ওষুধের পেছনে কমপক্ষে আট হাজার বিএফএ ফ্রাঙ্ক খরচ হয়ে যেত। ফার্মেসি চালু হওয়ার পর আমার আর খরচ করতে হচ্ছে না। পয়েন্টগুলো দিয়েই আমার যা দরকার তা আমি পেয়ে যাই।’

নিয়মিত পরীক্ষা করানো

পাসির সেবাকেন্দ্রের সেবিকা ও প্রশাসনিক কর্মীরাও নিয়মিত পরীক্ষা করাতে আসা রোগীর সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টা খেয়াল করেছেন। নাদিয়ে মারিয়েমে দিয়ালো হলেন জোক্কো সান্তের ম্যানেজার। তিনি রোগীদের আসার হার বাড়ার সঙ্গে কমিউনিটি ফার্মেসির সাফল্যের শক্তিশালী যোগসূত্র দেখতে পান। তাঁর কথায়, ‘যেহেতু দরকারি ওষুধ পাওয়া নিয়ে তাঁরা নিশ্চিত, সেহেতু রোগীরা আর আগের মতো একেবারে শেষ মুহূর্তে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য বসে থাকেন না।’

সেবাকেন্দ্রের লবিতে মাফৌরি বানগৌরা কেন্দ্রের ডেটাবেইসের হালনাগাদ করছিলেন। তিনিও নিশ্চিত করে জানালেন, গোষ্ঠীগত ফার্মেসির সুবাদে আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এই কেন্দ্রের সুবিধাগুলো ব্যবহার করছেন। ‘পাসির অধিবাসীদের মধ্যে যাঁদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ ছিল না, জোক্কো সান্তে তাঁদের জন্য এটা সম্ভব করে তুলেছে। তাঁদের যা দরকার তা তাঁরা পাচ্ছেন।’ গর্বের সঙ্গে বললেন তিনি।

২০১৫ সালে জোক্কো সান্তে আফ্রিকান উদ্যোক্তা পুরস্কারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতারত ৫ হাজার ১০০ প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভাবনী ষষ্ঠতম প্রকল্প হয়েছে।

নিজে নিজে ওষুধ সেবনের অবসান

চালু হওয়ার পর থেকে পাসির ৭৫০ জন এই কমিউনিটি ফার্মেসির সদস্য হয়েছেন। এর অর্থ ৬০০ পরিবারের এই গ্রামে প্রতি পরিবারের অন্তত একজন এর সদস্য। এই উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা হলেন আদামা কানে। তাঁর বিশ্বাস এই সাফল্যের পথ ধরে পাসিতে নিজে নিজে ওষুধ সেবনের যে ব্যাপক বিস্তৃত ও বিপজ্জনক অভ্যাস আছে, তার অবসান হবে। আদামা কান বললেন, ‘ওষুধ প্রাপ্তি এখন জলদিভাবে সবার জন্য সহজলভ্য, যা আবার সেবাকেন্দ্রে আসার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এর পরিণতিতে আমরা দেখতে পাই, ওষুধের অবৈধ বেচাবিক্রি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে গেছে। কমিউনিটি ফার্মেসিতে এক বছরে দুই লাখ ফ্রান্স সিএফএর সমমূল্যের ওষুধ দান করা হয়েছে। সোনাটেল, বোল্লোরে ও সোডিফার্ম কোম্পানির অনুদানে, বিনা বেতনের স্বেচ্ছাসেবীদের শ্রমে এবং গ্রামের মানুষের সক্রিয়ভাবে ওষুধ সংগ্রহ ও তাঁদের অব্যবহৃত ওষুধ দানের কল্যাণে, পাসির অনেক মানুষই এখন বিনা মূল্যে ওষুধ পাওয়ার সুবিধাভোগী।

ভাষান্তর: ফারুক ওয়াসিফ, স্পার্ক নিউজের সৌজন্যে