টেকসই উন্নয়নে দরকার যুবসমাজের ভূমিকা

.
.

আগামীকাল আন্তর্জাতিক যুব দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘এজেন্ডা ২০৩০ অর্জনের পথ—দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং টেকসই উৎপাদন ও ভোগ নিশ্চিতকরণ’, যেখানে টেকসই উন্নয়নের জন্য যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
এজেন্ডা ২০৩০-এর প্রথম ও দ্বাদশ লক্ষ্য হচ্ছে যথাক্রমে ‘সবখানে সব ধরনের দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই ভোগ ও উৎপাদনের ধরন নিশ্চিতকরণ’। আন্তর্জাতিক যুব দিবসে চলতি বছরের প্রতিপাদ্যের লক্ষ্য দারিদ্র্য এবং টেকসই উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সংযোগের ওপর গুরুত্ব আরোপ। আর এ গুরুত্ব উপলব্ধি করে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, পুষ্টির ঘাটতি এবং নাজুক স্বাস্থ্য, বিশেষত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।
যুব জনগোষ্ঠী যেহেতু সামাজিকভাবে গঠিত একটি শ্রেণির মধ্যে পড়ে, সে জন্য ‘যুব’র সংজ্ঞা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। যুব হচ্ছে জীবনের একটা পর্যায়, যাকে সাধারণত কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তরণের সন্ধিক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সময় ব্যক্তি পর্যায়ে বাড়তি কিছু সুবিধা ও অধিকার ভোগ করলেও মানুষ পূর্ণ বয়স্কের মর্যাদা পায় না। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘যুব’র ব্যাপ্তি ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত নরনারীকে যুবক–যুবতী বলে গণ্য করা হয়। যেভাবেই তাদের সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, যুবসমাজকে তাদের নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন করতে হবে এবং তাদের একটি শক্তি হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। কারণ, তারা সামাজিক–সাংস্কৃতিক কাঠামো এবং পরিপ্রেক্ষিতের ওপর প্রভাব ফেলে এবং তার মাধ্যমে প্রভাবিতও হয়ে থাকে।
এই ‘প্রভাব ফেলা’ এবং ‘প্রভাবিত হওয়া’র ব্যাপারটা সামাজিক–সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে যুবসমাজকে যখন এজেন্ডা ২০৩০ অর্জনের প্রচেষ্টায় সম্পৃক্ত করার জন্য ভাবা হচ্ছে। এ জন্য যা যা করতে হবে:
 যুবসমাজের ক্ষমতায়ন অবশ্যই হতে হবে, যাতে তারা তাদের অধিকার আদায় ও নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এটা দেশের এবং মানবতার অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
 বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধে কাজ করতে হবে। অল্প বয়সে বিয়ে, গর্ভধারণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগের অভাব (যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাসহ), পুষ্টির অভাব এবং লিঙ্গবৈষম্য এখনো লাখো কিশোরী ও নারীর অগ্রগতি ব্যাহত করছে। উন্নয়ন প্রচেষ্টায় তাদের যুক্ত করা যাচ্ছে না।
 দেশ থেকে অপুষ্টি দূর করতে হবে। অপুষ্টি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। ব্যক্তি পর্যায়ের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও এর প্রভাব পড়ে। অপুষ্টির কারণে প্রতিবছর উৎপাদন খাতে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। এই ক্ষতির প্রভাব জীবনভর স্থায়ী হয়। ফলে স্বাস্থ্য নাজুক হয়, শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে থাকতে হয় এবং উৎপাদনশীলতা ও উপার্জনের সম্ভাবনা কমে যায়।
 যুব জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।

বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ। দেশের উন্নয়নে যাতে জনসংখ্যার এই বিশাল অংশটি ভূমিকা রাখতে পারে, সে জন্য তাদের প্রভাবিত করতে হবে। সে জন্য যা করতে হবে সেগুলো হচ্ছে:
প্রথমত, দেশটির যুবসমাজের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও দক্ষতার উন্নয়নে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত ও জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কিশোরীদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের উন্নয়নকাজে তরুণদের সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করার প্ল্যাটফর্ম গড়ে দিতে হবে। তাদের অগ্রগতি ও মতামত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

কীভাবে এটা করা যেতে পারে?
যেহেতু বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ যুবসমাজ, তাই তাদের কার্যক্রমের একটা বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমান সময়ের দৃশ্যমান ভোগ প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তিগত পছন্দ এবং কার্যক্রমের গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরাটা জরুরি। এতে সার্বিক ভোগের কার্যকারিতা বাড়বে এবং অপচয় ও দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে। যুব জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত হতে হবে। একই সঙ্গে অন্যদের পরিবেশবান্ধব ভোগের বিষয়, এর হ্রাস, পুনর্ব্যবহার এবং ব্যবহৃত জিনিসকে আবার ব্যবহার উপযোগী করে তোলার মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে টেকসই উৎপাদন ও ভোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। যদি শুধু বাংলাদেশের যুব জনসংখ্যাও (প্রায় পাঁচ কোটি ২০ লাখ) নিজেদের ভোগের ধরন পাল্টায়, তাহলেও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়বে।
উৎপাদন ও ভোগের এই পরিবর্তনশীল ধরন দারিদ্র্য বিমোচনেও অবদান রাখতে পারে। দারিদ্র্য দূর করাই এজেন্ডা ২০৩০–এর প্রধান লক্ষ্য। দারিদ্র্যের প্রকাশ বহুমাত্রিক আর তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অপুষ্টি, অশিক্ষা, সামাজিক বৈষম্য, দুর্বল স্বাস্থ্য (বিশেষত, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য) প্রভৃতি। দারিদ্র্য দূরীকরণে শিক্ষা অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখে। যাদের কোনো শিক্ষা নেই, তাদের তুলনায় মাধ্যমিক বা আরও উঁচু পর্যায়ের শিক্ষা অর্জনকারী জনগণের মধ্যে দারিদ্র্য ছয়গুণ কম দেখা যায়। নগর এলাকায় অপুষ্টি, দারিদ্র্য আর জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর। এতে বোঝা যায়, কীভাবে এসব বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা একজন মানুষের কৈশোরের মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যায়ে প্রভাব ফেলে, যার প্রভাব পরবর্তী জীবনেও বইতে হয়।
যুবসমাজকে দারিদ্র্য হ্রাস করার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচেষ্টায় তাদের যুক্ত করতে হবে। এই দুই উপায়ে ২০৩০ সালের এজেন্ডা অর্জনে অবদান রাখতে তরুণদের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। সুস্থ, শিক্ষিত, কর্মে নিযুক্ত ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত যুবারা শুধু নিজেদের উন্নয়নই করে না; পাশাপাশি তারা পরিবার, সম্প্রদায় এবং দেশের উন্নতি করতে পারে। বাংলাদেশের সামনে এখন একটি জনমিতিক সুফল এর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ বিদ্যমান থাকবে ২০১১–৩১ সাল এর মধ্যে। কর্মশক্তিতে অনেক বেশি মানুষ যোগ দেওয়ার ফলে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় বেশি বেড়েছে উৎপাদনশীল মানুষের সংখ্যা। প্রমাণ মিলেছে, পরিবারে সন্তানসংখ্যা কম হলে তাদের পড়াশোনা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করার সুযোগ মেলে। এতে মানবসম্পদ যেমন সমৃদ্ধ হয়, তেমনি পরিবারের সদস্যরা নিজেদের অবসরজীবনের জন্য অধিকতর সঞ্চয় করতে পারেন এবং এভাবে তারা আরও বিনিয়োগ করে। তা ছাড়া মেয়েরা যদি শিক্ষা গ্রহণ করে এবং কাজ পাওয়ার যোগ্য হয়, তাহলে কর্মশক্তির বিকাশের মাধ্যমে অর্থনীতিও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হয়। গুটিকয়েক ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, যেসব দেশে প্রজনন হার কম—সেসব দেশ উচ্চ প্রজনন হারের দেশগুলোর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। আগামী ১০ বছরের মধ্যে সঠিক বিনিয়োগ না করলে এই জনমিতিক সুফল পাওয়া যাবে না।
টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে যুব জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার উদ্দেশ্য পূরণের পথে অগ্রসর হতে পারবে। তা ছাড়া তাদের নিজেদের শক্তির বিকাশের সুযোগ দেওয়াটা অত্যাবশ্যক। দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং টেকসই উৎপাদন ও ভোগ—এই দুটি ক্ষেত্রে যুব জনগোষ্ঠী কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আসুন, আন্তর্জাতিক যুব দিবসে যুবসমাজের অর্জনগুলোকে উদ্যাপন করি এবং তাদের সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি জানাই। বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও শান্তিপূর্ণ দেশে পরিণত করার জন্য এটা জরুরি।
ইউএনএফপিএ, কিশোর ও যুব থিম গ্রুপের চেয়ার।
ইংরেজি থেকে অনূদিত