রংপুরে ক্রিকেটার তৈরির আঁতুড়ঘর

চলছে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ। ছবি: প্রথম আলো
চলছে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ। ছবি: প্রথম আলো

‘শহরের আনাচকানাচে পথ চলতে গিয়ে চোখ পড়ে কিশোররা ছোট্ট জায়গার মধ্যেই ক্রিকেটের বল-ব্যাট চালাচালি করছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি আর দুচোখে স্বপ্ন দেখি তাদের নিয়ে কিছু কি করার নেই? রংপুর বিভাগীয় শহর হলেও খেলোয়াড়দের নিয়ে তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি নিয়ে আমাদের এলাকার ময়না চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলি। যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে লেভেল-১ সনদপ্রাপ্ত প্রশিক্ষক। সানন্দে এগিয়ে এলেন তিনি। মনের সাহস বেড়ে গেল। ভাবনা ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।’ রংপুরের আইজিএস ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠার কথা এভাবেই শোনালেন এর উদ্যোক্তা সেরাফুল হিমেল।

রংপুর শহরের কামালকাছনা দখিগঞ্জের পাশে একটি মাঠ ইজারা নিয়ে ২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাসে গড়ে তোলা হয় এই ক্রিকেট একাডেমি। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে কিশোর খেলোয়াড়দের নিয়ে চলে প্রশিক্ষণ।

মাত্র আড়াই বছরের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সফলতাও এসেছে। ক্রিকেট একাডেমি থেকে জানা গেল এরই মধ্যে পাঁচজন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে খেলছেন। এর মধ্যে একজন শুভাশীষ রায় জাতীয় ক্রিকেট দলের সেরা ২০-এর মধ্যে ছিলেন। আর অন্য চারজনের মধ্যে মোহাম্মদ রুবেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন। রিগান ও মামুন খেলছেন পারটেক্সের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ বয়েজের হয়ে রনিও খেলছেন ঢাকায় প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে। রয়েছে আরও সফলতা।

যেখানে ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ চলে সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে উঠতি কিশোর খেলোয়াড়েরা অনুশীলনে ব্যস্ত। মাঠের উত্তর দিকে সুন্দর পরিপাটি এবং গোছানো প্রশিক্ষণ ও ড্রেসিং রুম।

আইজিএসের প্রাণ সেরাফুল হিমেল (বঁ​ায়ে) ও ময়না চৌধুরী
আইজিএসের প্রাণ সেরাফুল হিমেল (বঁ​ায়ে) ও ময়না চৌধুরী

এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণার্থী খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়া হয় না। উপরন্তু ব্যাট, বলসহ খেলার সব সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন সম্ভব না হলেও মাঝেমধ্যে নাশতার ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে।

শুরু থেকেই এই একাডেমিতে বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ময়না চৌধুরী।

ময়না চৌধুরী জানালেন, এখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অনেকেই ঢাকায় খেলছেন। সেই সঙ্গে বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪, ১৬ ও ১৮-তে রংপুরসহ আশপাশের জেলায় খেলছেন কেউ কেউ। ‘এই একাডেমির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা খেলোয়াড়েরা কোথাও ভালো করলে প্রাণটা ভরে যায়।’

চলতি বছর দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত রংপুর বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৮ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে রংপুর জেলা দল রানারআপ হয়। সেই দলের টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান করার ট্রফি পায় এই ক্রিকেট একাডেমির ঐশ্বর্য চৌধুরী। গত বছর নীলফামারীর সৈয়দপুরে একাডেমি কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ‘আইজিএস’। জেলার প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে এই একাডেমির ছয়জন খেলোয়াড় কামালকাছনা ক্রিকেট সংস্থার হয়ে খেলে দলটিকে চ্যাম্পিয়ন করেছে। চলতি বছর রংপুর প্রিমিয়ার ডিভিশন টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এই ক্রিকেট একাডেমি রানারআপ হয়েছে।

বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪, ১৬ ও ১৮-তে রংপুর জেলা দলে খেলছে এই একাডেমির ১৫ জন খেলোয়াড়। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা দলে পাঁচজন খেলোয়াড় বয়সভিত্তিক টুনা‌র্মেন্টেও খেলছে। ময়না চৌধুরী বলেন, ‘এই একাডেমিতে বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছি। মাত্র আড়াই বছরের পথ চলায় অনেকটাই সফলতা এসেছে। ভবিষ্যতে এই একাডেমি থেকে ভালো খেলোয়াড় তৈরি হবে বলে আমরা আশাবাদী।’

৩০ জন কিশোরকে নিয়ে শুরু হয়েছিল এই একাডেমির প্রশিক্ষণ। পারফরম্যান্স বেশ ভালো হওয়ায় জেলার বিভিন্ন ক্রিকেট ক্লাবে তাদের ডাক পড়ে। একাডেমির সুনামও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে এখানে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বেড়ে শতাধিক হয়ে যায়। বর্তমানে আছে ৬০ জন।

এ জেলায় অনেক ক্রিকেট ক্লাব। কিন্তু খেলোয়াড়দের এত আগ্রহ থাকলেও তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই বলে জানালেন ‘আইজিএস’ ক্রিকেট একাডেমির উদ্যোক্তা সেরাফুল হিমেল। তিনি বলেন, ‘ক্লাবগুলো নিজেদের চেষ্টায় ক্রিকেট দল গঠন করে তাদের চেষ্টা চালিয়ে যায়। ঠিক এমন এক অবস্থায় একটি ক্রিকেট একাডেমি গঠন করার কথা ভাবলাম। বলা চলে হঠাৎই তা চালু হয়ে গেল।’ ‘আইজিএস’ নামে শহরের কামালকাছনায় সেরাফুলের গড়ে তোলা একটি বিদ্যালয়ও আছে। এই নামেই চালু হয়েছে ক্রিকেট একাডেমি। একাডেমি পরিচালনা করতে কোনো কমিটিও নেই। তবে এই একাডেমির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান হলো প্রশিক্ষক ময়না চৌধুরীর—জানালেন সেরাফুল হিমেল। আরও বললেন, ‘এই কাজটি চালিয়ে যেতে সব সময় উৎসাহ জুগিয়ে চলেছেন সাবেক ক্রিকেটার ও সংগঠক শাকিল আহমেদ, আখলাকুর রহমান খান, এ টি এম মহসিন, নাসিম বাবু ও রাজন।’

ভবিষ্যতে এই ক্রিকেট একাডেমির আধুনিকায়ন করার চিন্তাভাবনা রয়েছে সংগঠকদের। তাঁদের আশা, রংপুর থেকে আরও বেশি ভালো ক্রিকেটার তৈরি হবে।