১৫ জন থেকে ১৫ লাখ

‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পার করল ৩৫ বছর। আজ তাদের বর্ষপূর্তি উৎসব ও নতুন ভবনের উদ্বোধন। কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন পারভেজ হোসেন

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নবনির্মিত ভবনের সামনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: সৈকত ভদ্র
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নবনির্মিত ভবনের সামনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: সৈকত ভদ্র

প্রায় পৌনে দুই লাখ বই নিয়ে তিলে তিলে গড়ে ওঠা লাইব্রেরি, ছোট-বড় মিলিয়ে চারটি মিলনায়তন, আর্ট গ্যালারি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংগীত ও চলচ্চিত্রের আর্কাইভ, দলবেঁধে আড্ডা দেওয়ার উপযোগী দুটো ক্যাফেটেরিয়াসহ ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান বুকে গেঁথে নয়তলা যে ভবনটি এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলামটরে, ওটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবন। ইট-কাঠ-রড-সিমেন্টের মস্ত এক দালান হলেও আলো-হাওয়ার কমতি নেই। যেখানে যতটুকু পেরেছে উঁকি দিচ্ছে সবুজ। যেসব গাছ লাগানো হয়েছে, বড় হয়ে কংক্রিটের চোখরাঙানি মানবে বলে মনে হয় না।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৩৫ বছর পূর্তি উৎসব আজ; আর নতুন ওই ভবনেরও শুভ উদ্বোধন।
শিল্প ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উজ্জ্বল মানুষ, বিশ্বসংস্কৃতির বহতা হাওয়ায় নতুন জীবন পেয়েছেন যাঁরা—এককথায় যাঁরা সত্যান্বেষী, সংস্কৃতিমান, রুচিশীল, সৌন্দর্যপ্রবণ, সক্রিয় ও সৃজনশীল, তাঁদের নিরন্তর আসা-যাওয়া, সাহচর্য, মানস-বাণিজ্য ও বন্ধুতায় মুখর অঙ্গনটিতে মাথা উঁচু করা আজকের এই স্থাপনা। এই যে এত আয়োজন, তা কোন সে স্বপ্নের সফলতার কথা বলে?
৩৫ বছর আগে ফিরে যেতে হয়। ভাবনায় বড়, উচ্চ চেতনায় দৃঢ়, সংগ্রামী, আলোকিত মানুষ উপহার দেওয়ার বাসনা তাঁর মনে। কারণ, তিনি জানেন, ক্ষুদ্র মানুষ দিয়ে বড় জাতি গড়ে তোলা যায় না। উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু আয়োজন নিতান্ত অসম্পূর্ণ, পরিসরও সীমিত। আর্থিক সংগতি নেই বললেই চলে। তাতে কিছু যায়-আসে না। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে শ্রেণীকক্ষের বাইরে, কলেজ চত্বর ডিঙিয়ে ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়লেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ—আমাদের সায়ীদ স্যার।
পাঠচক্র দিয়েই শুরু। আশরাফুজ্জামান খানের ৩৫ টাকা চাঁদায় বই কেনা হলো। তারুণ্যের বিভায় উজ্জ্বল, মেধাবী, মনে প্রবল জিজ্ঞাসা—এমন ১৫ জনের একটি দল প্রিয় সায়ীদ স্যারকে নিয়ে পাঠ-পরবর্তী আলোচনায় মেতে উঠল তৎকালীন এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টারে। ড. লিয়াকত আলী, মিজারুল কায়েস, শাহ আলম সারওয়ার, রিয়াজুল হক, ইফতেখার উল ইসলাম, কামাল চৌধুরী, মিলু চৌধুরী, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, জুয়েল আইচ, হাসিমা গুলরুখ, মুজতবা সৌদ, সুশীল কুমার সূত্রধর ছিলেন ওই দলের অন্যতম—নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আজ তাঁদের সবাই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখনই ভেবেছিলেন, এই পাঠচক্র থেকেই এমন অনেকে বেরোবে, যারা হবে জাতির আলোকিতসম্পন্ন মানুষ। পাঁচ বছরে এদের সংখ্যা দাঁড়াল ৫০-এ। স্যারের স্বপ্ন তত দিনে আকাশ ছুঁয়েছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই স্বপ্ন দেখার শুরু কিন্তু স্কুলজীবনে। পাবনা জিলা সু্কলের দশম শ্রেণীর ছাত্র তিনি। ওই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ, জিয়া হায়দার, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আবদুস সামাদ—পরবর্তীকালে এঁরা সবাই খ্যাতিমান হয়েছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মকসুদ আলী একদিন বললেন, ‘আজ থেকে আর লাইব্রেরিতে যেতে হবে না, শ্রেণীকক্ষেই লাইব্রেরি বানিয়ে দেব।’ এরপর একটা ছোট বাক্সে ৩০ জন ছাত্রের জন্য ৫০টি বই এল। আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদরা কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন ‘ফিলসফিক্যাল সোসাইটি’। ওই সোসাইটিতে তাঁদের আলাপ-আলোচনার বিষয় বদলে গেল। আলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠল বই। সেই সব দিনের কথা জীবনে কোনো দিন ভোলেননি সায়ীদ স্যার।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে কিছু দিনের মধ্যেই তরুণদের একাগ্রতায়, নিষ্ঠায়, আত্মবিশ্বাসে ওই বদলটা আরও বড় করে চোখে পড়ল তাঁর। দেখলেন—বড় স্বপ্নে, বড় জীবনাগ্রহে উদ্বুদ্ধ, বুদ্ধিমান, মেধাবী, সৃজনশীল, শক্তিমান, সমমনা তারুণ্যের যূথবদ্ধতা—মানবিকতার সম্পন্ন বিকাশ। অনেকটা আশান্বিত হলেন আলোকিত মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ভাবলেন, দেশের আগ্রহী সব ছেলেমেয়েকেই তো এর মধ্যে আনা যায়। প্রথমে শুরু হলো কলেজ কর্মসূচি। ১৯৮৪ সালে এর সভ্য সংখ্যা দাঁড়াল সাড়ে তিন হাজার। স্কুল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যা এখন ১৫ লাখের কাছাকাছি। বলা যায়, ১৫ জন নিয়ে শুরু হওয়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৩৫ বছর পূর্তির ক্ষণে এখন ১৫ লাখের দিকে ধাবিত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ আর কেবল ‘প্রতিষ্ঠান’ নয়, এটি একটি ‘আন্দোলন’—আলোকিত জাতীয় চিত্তের একটি বিনীত নিশ্চয়তা।
‘আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামোকে সংহত করতে পারিনি। এই অসংহত রাষ্ট্রকাঠামোর কারণে পশ্চিমা সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ আমাদের মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার বদলে আজ ভূলুণ্ঠিত। মানুষ এখন আত্মকেন্দ্রিক, ভোগবাদী লুটেরায় পরিণত হয়েছে।’—খুব খেদের সঙ্গে বললেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
৮ মার্চ। বিকেলের আলো তখন নিবুনিবু। কেন্দ্রের নতুন ভবনজুড়ে রবীন্দ্রসংগীতের আবহ। এর মধ্যে ছয়তলায় নিজের ঘরে বসে সায়ীদ স্যার বললেন, ‘আমি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেও শিক্ষকতাই করছি। এটা আসলে একটা বড় আকারের শিক্ষকতা। শিক্ষকতা করার জন্য আমি সংগঠন করতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের আলোকিত মানুষের আন্দোলন এখন একটা বৈরী সময়ের বিরুদ্ধে চলছে। যে পরিমাণ সাফল্য আসার কথা, তা যদিও পাইনি, কিন্তু এখন তো প্রদীপ ধরে রাখার সময়। দুর্দিনে টিকে থাকা সুদিনে বিপ্লব করার সমান। কালের চাকা ঘুরছে। আজ হয়তো সে আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে; তবে যেহেতু সে ঘুরছে, একদিন না একদিন আমাদের পক্ষে সে আসবেই। তাই যে আলোর সন্ধান আমরা পেয়েছি, তাকে জ্বালিয়ে রাখার অব্যাহত সংগ্রাম আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের এই ছেলেমেয়েরা দেশটাকে বদলাবেই।’

ছাদের ক্যাফেটরিয়ায় সভ্যদের সঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছাদের ক্যাফেটরিয়ায় সভ্যদের সঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

যা আছে নতুন ভবনে
চারটি মিলনায়তন: দ্বিতীয় তলায় শীতাতপ ও শব্দ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাসহ রয়েছে ২০০ আসনের অত্যাধুনিক ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তন। এ ছাড়া ৭৮ আসনের চলচ্চিত্র মিলনায়তন রয়েছে একই তলায়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় আছে যথাক্রমে নব্বই ও ১১০ আসনের আরও দুটি মিলনায়তন। তা ছাড়া সপ্তম তলায় আছে ৫৫ আসনবিশিষ্ট সুপরিসর সম্মেলনকক্ষ।
লাইব্রেরি: তৃতীয় তলার পৌনে দুই লাখ বইসমৃদ্ধ চার হাজার বর্গফুটের ডুপ্লেক্স লাইব্রেরিতে থাকছে কেন্দ্রের সভ্যদের পাশাপাশি জনসাধারণের বই পড়ার সুযোগ।
বই বিক্রয়কেন্দ্র: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত বইয়ের পাশাপাশি এখানে থাকছে দেশি-বিদেশি সৃজনশীল বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের সমাহার। বিক্রয়কেন্দ্রটি দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত।
ক্যাফেটরিয়া: পঞ্চম তলার ক্যাফেটরিয়ায় রয়েছে ৫০ জন একসঙ্গে বসার ব্যবস্থা। এ ছাড়া ভবনের ছাদেও আছে আরেকটি ক্যাফেটরিয়া।
চিত্রশালা: পঞ্চম তলায় অবস্থিত চিত্রশালায় রয়েছে একসঙ্গে ৫০টি চিত্রকর্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা।
সংগীত ও চলচ্চিত্র সংগ্রহশালা: অষ্টম তলার এ সংগ্রহশালায় পাওয়া যাবে বিশ্বের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ও সংগীতের রেকর্ড।