Thank you for trying Sticky AMP!!

তিতাসে 'কেজি মেপে' ঘুষ লেনদেন

  • বেরিয়ে এসেছে তিতাসের ঘুষ-দুর্নীতির অভিনব চিত্র
  • ঘুষ খাওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার
  • সাংকেতিক ভাষায় এক কেজি মানে এক লাখ টাকা
  • ঘুষ এনে দিতে মাঝখানে একটি দালালশ্রেণিও তৈরি
  • দালালেরা ঘুষের টাকা পৌঁছে দেন বড় কর্তাদের কাছে
  • এমডি মশিউরের নেতৃত্বে ঘুষের চক্র গড়ে উঠেছে
  • এমডির প্রধান সহযোগী শাখার ব্যবস্থাপক সাব্বের

‘তিন কেজি দেওয়া হয়েছে সেক্রেটারি মোশতাককে, টেপাকে ১৫’; ‘সবুর ও জাহাঙ্গীর ৪ কেজি নিয়েছে’; ‘আপনার ৬ কেজি কবে নেবেন?’

এই কেজি কিন্তু ওজনের পরিমাপক না, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের সাংকেতিক ভাষা। এক কেজি মানে এক লাখ টাকা।

গাজীপুর, সাভার, ভালুকা ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে এই ঘুষ খাওয়ার জন্য তিতাসের কর্মকর্তারা একে অপরের সঙ্গে এই সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। নিজেরা ঘুষ খাওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ এনে দিতে মাঝখানে একটি দালালশ্রেণিও তৈরি করেছেন তাঁরা। দালালেরা ঘুষের টাকা সরাসরি পৌঁছে দিয়েছেন তিতাসের বড় কর্মকর্তাদের কাছে।

সরকারি একটি নজরদারি সংস্থা থেকে পাওয়া তিতাসের কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোনের খুদে বার্তা, ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এই লেনদেন ও ঘুষ-দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। খুদে বার্তাগুলো ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের। তিন মাসের চিত্র পাওয়া গেলেও ঘুষের ঘটনা মাসের পর মাস ধরে চলছে বলে তিতাসের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে। এ নিয়ে পরে অনুসন্ধান করেছে প্রথম আলো। তাতে দেখা গেছে, চলতি দায়িত্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমানের নেতৃত্বে ঘুষের একটি চক্র গড়ে উঠেছে তিতাসে। আর এমডির প্রধান সহযোগী হচ্ছেন তিতাসের পাইপলাইন ডিজাইন বিভাগের একটি শাখার ব্যবস্থাপক সাব্বের আহমেদ চৌধুরী।

চক্রে আরও আছেন তিতাসের ইলেকট্রিক্যাল কোরেশন কন্ট্রোল (ইসিসি) বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমান, গাজীপুরের চলতি দায়িত্বের মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে জিএম, ভিজিল্যান্স) এস এম আবদুল ওয়াদুদ এবং সাবেক কোম্পানি সচিব ও বর্তমানে সুন্দরবন গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমডি মোশতাক আহমেদ।

ঘুষের ঘটনা সাব্বের আহমেদ চৌধুরী গাজীপুর বিক্রয় অঞ্চলে এবং মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমান টঙ্গী উত্তরের সিস্টেম অপারেশন বিভাগের ব্যবস্থাপক থাকার সময়ের। তিতাসের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চক্রটি ঘুষ খেয়েছে প্রধানত স্থাপনা পুনর্বিন্যাস, গ্রাহকদের অবৈধ গ্যাস-সংযোগ, গ্যাসের অবৈধ লোড বৃদ্ধি, অনুমোদন অতিরিক্ত স্থাপনা ব্যবহারের অবৈধ সুযোগ এবং পছন্দসই পদায়নকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) একটি কোম্পানি হচ্ছে তিতাস। ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫৬ কিলোমিটার পাইপলাইন থাকা কোম্পানিটির মোট শিল্প-গ্রাহক ৪ হাজার ৬১০। তবে ঘুষ নিতে প্রধানত ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুর অঞ্চলের শিল্প-কারখানার মালিকদের বেছে নিয়েছে চক্রটি। তিতাসের গ্যাস-সংযোগ পাওয়া বেশির ভাগ কারখানা গাজীপুর অঞ্চলেই।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) কার্যালয়ে গত ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক সভায় ব্যবসায়ীরা তিতাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। বিটিএমএর পরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম ওই দিন বলেন, ‘তিতাসের অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে গেছি।’

তিতাসের কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে জানতে চাইলে কোম্পানি আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি আইন নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীব-উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা অনুযায়ী তাঁদের ৭ বছরের জেল হওয়ার কথা।’ তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর উচিত হবে অভিযুক্তদের সম্পদ বিবরণী তল্লাশি করে গভীরতর অনুসন্ধান করা।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এ নিয়ে গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাসের চোরেরা সব সময়ই চুরি করে। হাতেনাতে ধরা না পড়ায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।’

খুদে বার্তায় ঘুষের আলাপ
খুদে বার্তার রেকর্ডে দেখা যায়, গাজীপুরে অবস্থিত এএমসি নিট কম্পোজিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী প্রদীপ দাসের কাছ থেকে তিতাস কর্মকর্তা সাব্বের আহমেদ চৌধুরী পরিবার যে ঘুষ নিয়েছে, এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা নেওয়ার একটি ঘটনা ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবরের। ওই দিনের সাব্বের-প্রদীপের খুদে বার্তাগুলো এ রকম: সকাল ৮টা ২৭ মিনিটে প্রদীপ সাব্বেরকে ‘বস’ সম্বোধন করে জানতে চান, টাকা তিনি কোথায় পৌঁছাবেন। ৯টা ১৩তে সাব্বের প্রদীপকে প্রশ্ন করেন, ‘কত কেজি?’ চার মিনিট পর প্রদীপ জানান, ‘টাকাটা গাজীপুর থেকে তুলে দেব। চেষ্টা করব ১ হাজার টাকার নোট ব্যবস্থা করার জন্য। তাতে যে কয় কেজি হয়।’

একই দিন ৯টা ২২ মিনিটে সাব্বের প্রদীপকে কেজির ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, ‘কেজি মানে অ্যামাউন্ট।’ এর ১ মিনিট পর প্রদীপ সাব্বেরকে বলেন, ‘এ জন্য আমি একটু কথা বলব, আপনি শুধু শুনবেন আর হ্যাঁ-না বলবেন।’ ৯টা ৫৪ মিনিটে প্রদীপ সাব্বেরকে আবার বলেন, ‘এদের সামনে বলবেন যে ৫০ পুরা দিতে হবে রোববারের মধ্যে।’ ১০টা ১৮ মিনিটে প্রদীপ জানান, ‘আমি ৫০ দেব।’ একই দিন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে প্রদীপ সাব্বেরকে বলেন, ‘বস, ভাবিকে ৫০ বুঝিয়ে দিলাম। প্লিজ, কনফার্ম।’

যে মোবাইল ফোন নম্বরে প্রদীপ ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর সাব্বেরের সঙ্গে এত কথা বলেছেন, সেই নম্বরটিতে তিন মাস ধরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বারবার ফোন করা হয়েছে। কিন্তু নম্বরটি বন্ধ। এএমসি নিট কম্পোজিট থেকে তাঁর বর্তমান মোবাইল নম্বরটি সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো, সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটর সূত্রে জানা গেছে, নতুন নম্বরটি তিনি ব্যবহার করছেন ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে।

প্রদীপ দাসের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে গত ২ জুলাই গাজীপুরের বানিয়ারচালায় এএমসি নিট কম্পোজিটে গেলে কারখানার নিরাপত্তা প্রহরী মানিক জানান, তিনি ভেতরে আছেন, দেখা চাইলে অপেক্ষা করতে হবে। ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর একই প্রহরী জানান, ‘স্যার (প্রদীপ দাস) বলেছেন, তিনি ব্যস্ত।’ বর্তমান মোবাইল ফোনে কথা বলতে আসার কারণ জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠালে প্রতিবেদককে ফিরতি খুদে বার্তায় প্রদীপ দাস জানান, তিনি প্রদীপ দাস নন।

গত ৪ জুলাই এএমসি নিটের এমডি মো. এনামুল হকের মোবাইল ফোনে প্রদীপ দাসের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার কারণ জানালে তিনি তাঁর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদককে ফোন দেবেন বলে জানান। এরপর এনামুল হকও আর ফোন ধরছেন না।

একইভাবে গাজীপুরের ভিয়েলাটেক্স লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান থেকে সাব্বেরকে ঘুষের টাকা এনে দেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ তাইমুর আলম। ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর সকাল ১০টা ২৯ মিনিটে সাব্বের তাইমুরকে বলেন, ‘এক সাথে দেন। ফার্স্ট ডিল কমপ্লিট, প্লিজ।’ পরদিন ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ৩ মিনিটে সাব্বের আবার তাঁকে বলেন, ‘এটা কি ফাইনাল কন্ট্রাক্টে ছিল? আপনার জন্য কিছু রাখব?’ একই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিট তিনি তাইমুরকে আবার বলেন, ‘চেষ্টা করেন ৫০ দিতে। আমি কাল ঢাকায় আসব। আগামীকাল ২০ দিতে পারেন। বাকি ১০ আপনার।’

ভিয়েলাটেক্সের তাইমুর আলম গত ২০ মে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে বিব্রত। আর জিম্মি করে যে তিতাসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা টাকা আদায় করেন, এ কাহিনি তো সবারই জানা।’

সরকারি সংস্থার তথ্যেই উঠে আসে সাইফুল ইসলাম ও স্বপন নামের তিতাসের তালিকাভুক্ত দুই ঠিকাদারও সাব্বেরকে ঘুষ এনে দেওয়ার কাজে যুক্ত, যার ভাগীদার তাঁরা নিজেরাও। যেমন মাহমুদ গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান মাহমুদ ডেনিম, মাহমুদ ফ্যাশন এবং ডং ব্যাং। মাহমুদ ফ্যাশনের পক্ষে ২০ লাখ টাকা সাব্বেরকে দেন ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম। আবার ডং ব্যাংয়ের জন্য তিতাসের মূল সঞ্চালন লাইন থেকে সংযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে মাহমুদ গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলামের কাছ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা নেন সাব্বের, যে টাকার ভাগ পেয়েছেন ঠিকাদার সাইফুলও। সংযোগ এখনো হয়নি।

তথ্যে আরও উঠে আসে, গাজীপুরের চলতি দায়িত্বের মহাব্যবস্থাপক (জিএম, ভিজিল্যান্স) এস এম আবদুল ওয়াদুদ গাজীপুরের বিনোদা টেক্সটাইল থেকে নেন ২০ লাখ টাকা। এদিকে তিতাসের সঞ্চালন লাইন থেকে এনআরজি এবং এটিঅ্যান্ডটি নামের দুই প্রতিষ্ঠানকে সংযোগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন সাব্বের-সিদ্দিকুর জুটি। আবার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে আগে থেকেই গ্রাহকদের সাবধান করে দেন সাব্বের। যেমন সাব্বের এক খুদে বার্তায় এএমসি নিটের প্রকৌশলী প্রদীপ দাসকে জানিয়ে দেন, ‘ভিজিল্যান্স টিম ইজ ইন দ্য ফিল্ড। সো বি অ্যালার্ট অ্যান্ড কিপ ইন টাচ।’

ঘুষের আলাপে ভাইয়ের ফোন!
গ্রামীণফোনের যে নম্বরটি ঘুষ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন সাব্বের, গ্রাহক নিবন্ধন ফরম অনুযায়ী, এর নিবন্ধন তাঁর ভাই সাজ্জাদ আহমেদ চৌধুরীর নামে। সাজ্জাদ ওয়েস্টকেম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি ইটিপি কেমিক্যাল বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও এমডি।

যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের (আরজেএসসি) কার্যালয় থেকে ২০১২ সালের ২৯ মার্চ নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টকেম। অনুমোদিত মূলধন ৩ কোটি টাকা হলেও পরিশোধিত মূলধন ৬০ লাখ টাকা। নিবন্ধন নেওয়ার সময় ১০০ টাকা মূল্যের ১৫ হাজার করে শেয়ার নিয়ে পরিচালক ছিলেন সাজ্জাদ, সাব্বেরের স্ত্রী রুমানা রিশাত জামান এবং সৈয়দ জাহিদ পারভেজ ও সুব্রত পাল নামের দুজন। সুব্রত পাল তখন এমডি ছিলেন। চারজনের মোবাইল নম্বর একই সিরিজের।

যে মোবাইল ফোনে সাব্বের ঘুষের আলাপ করেছেন, আরজেএসসিতে তা তাঁর স্ত্রীর নামে দেখানো। ওয়েস্টকেমের এমডির দায়িত্ব পালনকারী সুব্রত পাল ২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৫ হাজার করে মোট ১৫ হাজার শেয়ার তিনজনের কাছে হস্তান্তর করেন এবং নতুন এমডি হন সাজ্জাদ।

জানতে চাইলে সাজ্জাদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, মোবাইল ফোন নম্বরটি তাঁর ভাই সাব্বের আগে ব্যবহার করলেও এখন করেন না।

এমডি কীভাবে জড়িত
২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর সকাল ১০টা ১২ মিনিটে সাব্বের ‘৫৫-২৪ = ৩১। আপনার ১০ দশমিক ৫, আমার ১০ দশমিক ৫, এমডি ও সিদ্দিক ১০। সুতরাং আপনি আমাকে ২০ দশমিক ৫ দেবেন’-এ রকম একটি খুদে বার্তা দেন ঠিকাদার স্বপনকে। একই দিন ১০টা ১৫ মিনিটে সাব্বেরকে স্বপন জানান, ‘ঠিক আছে, তবে কোথায় টাকা পৌঁছাব।’ চার মিনিট পর ঠিকাদার স্বপন সাব্বেরকে বলেন, ‘ভাবির কাছে পৌঁছে দিচ্ছি।’

২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর বেলা ১টা ১৪ মিনিটে সাব্বের এক খুদে বার্তায় তিতাসের এমডি মীর মশিউর রহমানকে জানান, ‘স্যার, আপনার ১৪০ কেজি (নোমানের ৫০ ও কাদেরের ১ বাদে)।’ ১৪০ কেজি মানে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এমডির ভাগটাও সাব্বেরের কাছেই দিতে হবে, যে ভাগের অঙ্ক কোটি টাকার বেশি।

খুদে বার্তাগুলো থেকে ধারণা হয়, ঘুষের সঙ্গে পদায়ন ও পদোন্নতির সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন লোকদেরই বসানো হয়েছে, যাঁরা ঘুষ-চক্রের মধ্যে রয়েছেন। সাব্বের এক খুদে বার্তায় সিদ্দিকুরকে বলেন, ‘তোমার ৩৬ দশমিক ৫, এমডি ১৪০ এবং নোমান ৫০।’ সিদ্দিকুরের কাছে সাব্বের ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর সকাল ৯টা ৫৩ মিনিটে জানতে চান, ‘তোমার কাছে এমডির কত আছে?’ ঠিকাদার স্বপনকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় সাব্বেরের ঘুষের টাকার ভাগাভাগি দেখা যায় এভাবে, ‘এমডি ৪, সিদ্দিক ৩, আমি ৬, তুমি ৫ ’।

ঠিকাদার স্বপনের কাছে গতকাল বুধবার মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে স্বীকার করেন যে তিনি তিতাসে ঠিকাদারি করেন কিন্তু ঘুষের মধ্যস্থতা করেন না। সাব্বেরের বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে টাকা পৌঁছে দিয়েছেন বলে প্রথম আলোর কাছে তথ্য রয়েছে-এ কথা জানালে স্বপন বলেন, তিনি সাব্বের আহমেদ চৌধুরী নামে কাউকে চেনেনই না।

সাব্বের ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর বেলা ৩টা ২৮ মিনিটে এমডির দুটি নম্বরে একটি কোম্পানির নাম উল্লেখ করে একই খুদে বার্তা দিয়ে বলেন, ‘স্যার, ভিজিল্যান্স টিম এক্সেস লোড পাইছে, লাইন যেন না কাটে, উই আর ডিলিং উইথ কাস্টমার’। একই খুদে বার্তা এমডির তৃতীয় নম্বরটিতেও ৩টা ৪২ মিনিটে পাঠান সাব্বের। তিতাস সূত্রে জানা গেছে, এই কোম্পানির লাইন আর কাটা হয়নি।

এদিকে অধস্তন কর্মকর্তা হয়েও সাব্বের-এমডির কথাবার্তা তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। এমডি তাঁকে বলেন, ‘উই উইল মিট অ্যাট হ্যাঙ আউট।’ এমডিকে পাঠানো সাব্বেরের আরও খুদে বার্তা হচ্ছে, ‘সুমন দাসের (সাভার অঞ্চলের উপব্যবস্থাপক) পোস্টিংটাও করে দিয়েন’; ‘এটিআই, এস এম নিটিং, এলিগেন্ট ওয়াশিং ডিরেক্টর অপারেশনকে বলেন ড্রিলের ফাইল অনুমোদন করতে’; ‘মাহমুদ গ্রুপের কাজ আমরা নিয়েছি’; ‘বিনোদা রিকানেকশন ছেড়ে দিয়েন’; ‘স্যার, কাজটা আটকিয়ে রাখতে বলেছি আমি। পরে আলাপ করব।’ ‘স্যার, ওকে না বললে তো বুঝতে পারি না এসএমএসটা পাইছেন কি না।’

অন্যদের কথায়ও এমডির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। যেমন সাব্বেরকে আবু বকর সিদ্দিকুর ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর খুদে বার্তা দিয়ে জানতে চান প্যারাগনের (একটি কোম্পানি) সঙ্গে কত টাকায় চুক্তি করবেন তিনি। পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর সিদ্দিকুর আবার সাব্বেরকে জানান, ‘প্যারাগনের ফাইল ও ব্যাগ আমার কাছে। এমডিরে প্যারাগন রিকানেকশন কত বলব?’

সাব্বের ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর অন্য এক খুদে বার্তায় সিদ্দিকুরকে জানান, ‘আগামীকাল ২টা ৩০ মিনিটে আমার ২৫ কেজি আপেল লাগবে।’ জবাবে সিদ্দিকুর তাঁকে জানান, ‘বাদ দাও তো। টাকা কি তোমার কম আছে?’

গত ৫ জুলাই তিতাস কার্যালয়ে ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয় এবং তিনি ঘুষ খাওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তারিখ ও খুদে বার্তাগুলো হুবহু উল্লেখ করে জবাব চাইলে সিদ্দিকুর বলেন, ‘এ ধরনের খুদে বার্তার কথা আমার মনে পড়ছে না। আর নিয়মানুযায়ী প্যারাগনের ফাইল আমার কাছে আসার কথা নয়, আসেওনি।’

ঘুষের আরও কথাবার্তা
তিতাসের অন্য কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও গ্যাস-সংযোগ পাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাব্বেরের উল্লেখযোগ্য খুদে বার্তাগুলো হচ্ছে, ‘আমি ৬, তুমি ৪, তোমার পাওনা ২। তাই তুমি আমাকে ৪ দেবে।’

এ ছাড়া ‘অগ্রিম টাকা আর ফাইল নিয়ে হেড অফিসে আমার লোক বসে আছে। আমার ভাগে কত? ৪৫?’ ; ‘সাইফুলকে ১০ লাখ দেওয়া হলো, আগামীকাল আরও ২০ দেওয়া হবে’; ‘ফর অডিট এবং পেট্রোবাংলা ইউ উইল পে ১ লাখ’; ‘তিন কেজি দেওয়া হয়েছে সেক্রেটারি মোশতাককে, টেপাকে ১৫, এটিআই ব্যাগ থেকে ১৭ নেওয়া হয়েছে’; ‘সবুর ও জাহাঙ্গীর ৪ কেজি নিয়েছে’; ‘আপনার ৬ কেজি কবে নেবেন?’ ; ‘গোনা ছিল না,৭ হতে পারে’; ‘এমডির কেজি থেকে ৬, এসএবিডিকে ৫, ডিরেক্টরকে ১০ ’; ‘১৮১ কেজি থেকে ৪ দিবা’-এসব খুদে বার্তাও রয়েছে।

আরও রয়েছে, ‘আপনার ফাইল অনুমোদন হয়েছে। আগামীকাল সাইফুল আপনার সঙ্গে দেখা করবে। অনুমোদনটির জন্য অফিস খরচ বাবদ এক কোটি টাকা দেবেন’; ‘কাল আপনার সময়মতো দেখা করে আমার ১০ নিয়ে যাব।’ তিতাস সূত্রে জানা গেছে, এটি হচ্ছে তিতাসের সংযোগ পাওয়ার জন্য একটি কোম্পানির আবেদন।

সবুর, জাহাঙ্গীর, টেপা, নোমান ও কাদেরের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। তবে একজন ঠিকাদারের সঙ্গে গত ২৬ জুন কথা হয় প্রথম আলোর। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি জানান, তিন বছর ধরে তিনি কিছু কোম্পানি ও তিতাসের সাব্বের আহমেদ চৌধুরীর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন, বিনিময়ে দুই পক্ষ থেকেই কমিশন পাচ্ছেন। দুই পক্ষে কথাবার্তা পাকা হওয়ার পর তিনি শুধু টাকা পৌঁছে দিয়ে আসছেন ঢাকার একটি অভিজাত এলাকার বাসায়। এক বছর ধরে কাজ একটু কম।

ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাব্বের এই প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন নম্বরে গত ১১ এপ্রিল পাঠানো এক খুদে বার্তায় তিতাসের ইসিসি বিভাগের ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিকুরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর প্রায় এক মাস চেষ্টা করে গত ১৫ মে সাব্বেরের দেখা পাওয়া যায় ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে। দিন-তারিখ উল্লেখ করে তাঁর অব্যাহত ঘুষ নেওয়ার চিত্র তুলে ধরলে প্রথম আলোকে সাব্বের বলেন, ‘এগুলো ষড়যন্ত্র। যাঁরা ঘুষ দিয়েছে বলে বলছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন।’

তিতাস গ্যাসের চলতি দায়িত্বের এমডি মীর মশিউর রহমানের সঙ্গে গত ২৩ এপ্রিল তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করলে তিনি ঘুষের ভাগ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে কম দেননি। এক জীবনে কত টাকা লাগে? আমি কেন ঘুষ খেতে যাব?’

আপনি ঘুষের টাকার ভাগীদার, মোবাইলের খুদে বার্তায় এর চিত্র উঠে এসেছে এবং প্রথম আলোর কাছে এই তথ্য আছে-এমন প্রশ্নের জবাবে মীর মশিউর বলেন, ‘আপনি যে ভিত্তিতে বলছেন, তা ঠিক নয়। অহেতুক কেউ আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছে।’

অহেতুক কেউ বিরুদ্ধে লাগার কারণ কী-জানতে চাইলে মীর মশিউর বলেন, ‘হয়তো ভালো পদায়ন হচ্ছে না।’

প্রতিকার চান ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা
বিটিএমএ কার্যালয়ে গত ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভায় সংগঠনটির সাবেক সভাপতি মতিন চৌধুরীও বলেন, ‘গ্যাস-সংযোগ পেতে তিতাসকে বাড়তি কয়েক কোটি টাকা দিতে হয়। তিতাসের লোকজন এতটাই সংঘবদ্ধ যে তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করা যায় না।’

এরপর ভিন্ন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে গত ৪ মে ঢাকা ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সভায় গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির সাবেক পরিচালক খন্দকার সালেক সুফি বলেন, তিতাস থেকে প্রতি মাসে যে পরিমাণ গ্যাস চুরি হয়, তা দিয়ে আরও কয়েক শত কারখানায় গ্যাস-সংযোগের পাশাপাশি ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তরা চুরির সঙ্গেও যুক্ত।

তিতাসে ভালো ভাবমূর্তি থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানিটিতে প্রকৃত চুরি আরও বেশি এবং এই চুরি বন্ধ হলে তাঁরা অতিরিক্ত লভ্যাংশ থেকে আরও বেশি বোনাস পেতেন, সরকারও পেত আরও বেশি রাজস্ব। চুরি করা গ্যাসই অবৈধ সুবিধা দিতে ব্যবহৃত হয় এবং এর ওপরেই ঘুষ-সাম্রাজ্য টিকে আছে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইন নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অনীক আর হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাসের শীর্ষ পর্যায়ের এই কর্মকর্তাদের ঘুষ-কাণ্ড সরকারের ভাবমূর্তির জন্যও ক্ষতিকারক। সরকারের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখা এবং দোষী প্রমাণিত হলে যথা-শাস্তির ব্যবস্থা করা।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাসে যে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা কার্যকর নেই, তারই বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে কোম্পানিটির কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ওঠা এই গুরুতর অভিযোগ। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের যোগসাজশ থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়।’

ইফতেখারুজ্জামানের পরামর্শ হচ্ছে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তিতাসের এই সংঘবদ্ধ দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শেষে দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিক। আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজের মতো তদন্ত করে আরও গভীর কিছু বের করুক।