Thank you for trying Sticky AMP!!

অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

কল্পনা দত্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকে লিখেছেন, তাঁকে দেখলে অবাঙালি বলে মনে হতো। সাধারণ বাঙালি নারীদের থেকে অনেক বেশি লম্বা, ছিপছিপে সুন্দর গড়ন, বলিষ্ঠ ঋজুদেহ, গায়ের রং কাঁচা হলুদ; আর হাসি ছিল ভীষণ মিষ্টি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দুজন নারীর নাম জড়িয়ে আছে, তাঁদের একজন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, অন্যজন কল্পনা দত্ত। এই ২৭ জুলাই ছিল বিপ্লবী কল্পনা দত্তের জন্মদিন।

১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর গ্রামে কল্পনা দত্তের জন্ম। তাঁর বাবা বিনোদবিহারী দত্ত ও মা শোভনবালা দত্ত। কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইংরেজ সরকার তাঁর ব্যক্তিত্বকে সম্মান দিত। ফলে তাঁদের বাড়ি পুলিশের নজরের বাইরে ছিল। শৈশব থেকেই কল্পনা মানসিক দিক থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন। শৈশবে তিনি কামনা করতেন সংসারে যেন দুঃখ না থাকে, সবাই যেন সুখে দিন কাটাতে পারে। এই যে চাওয়া এই চাওয়াই তাঁকে দেশের প্রয়োজনে বিপ্লবী করে তুলেছে। বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন স্বভাবে দরদি ও কোমল মেয়েরা বিপ্লবী কাজে অনুপযুক্ত। ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শ খারাপ হতে পারে। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, ‘It was an iron rule for the revolutionaries that they should keep aloof from the women.’ তিনি বলেই থেমে থাকেননি। সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন যারা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। বোমা পিস্তল নিয়ে কাজ করার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তাঁরা।

কল্পনা দত্তের জীবন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে বারো বছর বয়স থেকেই তিনি স্বদেশি বই পড়তে আগ্রহী হন। বিপ্লবীদের জীবনী, ’পথের দাবি’—এ ধরনের স্বদেশি বই পড়তে পড়তে তাঁর মনে হতো ব্রিটিশ সরকারকে সরাতে পারলেই দেশের দুঃখ দূর হবে। তাঁর ছোট কাকা তাঁকে আদর্শ দেশ-সেবিকারূপে গড়ে ওঠার প্রেরণা দিতেন। পড়াশোনায় মেধাবী কল্পনা চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হন। তারপর চলে যান কলকাতায়। ভর্তি হন বেথুন কলেজে বিজ্ঞান শাখায়। সেখানে পড়ার সময়ই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগে তাঁর মনে। স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে প্রতি সকালে কলেজ কম্পাউন্ডে সাইকেলে ঘুরপাক খাওয়া, প্রতি রোববার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন তিনি। সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সদস্য হয়ে কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন।

তারপর তিনি যোগ দেন কল্যাণী দাসের ‘ছাত্রী সংঘে’। তারপর বেথুন কলেজে হরতাল ও অন্যান্য আন্দোলনে অংশ নিতে থাকেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা সূর্যসেনের অনুগামী পূর্ণেন্দু দস্তিদার কল্পনার মতো একজন বিপ্লবীমনস্ক নারীকে পেয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এভাবেই বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়। পরে কল্পনা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিপ্লবী কাজে। চলে আসেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে এসে বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের মারফতে সূর্যসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হন। ১৯৩১ সালের মে মাসে কল্পনার সঙ্গে মাস্টারদার সাক্ষাৎ হয়।

ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে কল্পনা দত্তের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কলকাতা থেকে বোমা তৈরি করার মালমসলা সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের বাড়িতে বসে গান কটন তৈরি করেন তিনি। সেগুলো চলে যেত জেলের ভেতরে। চট্টগ্রাম জেলে অনন্ত সিংদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো কল্পনা দত্তের মাধ্যমে। ১৯৩১ সালের ডিনামাইট ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিনই পুলিশের নজরে আসে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আদেশ দেয় সরকার। চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি পড়ার অনুমতি মিললেও অন্যত্র যাতায়াত বন্ধ হয়। সে সময় রাতে পালিয়ে তিনি সূর্যসেন, নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতে গ্রামে চলে যেতেন। এই সময়ের মধ্যে রিভলবার চালাতেও অভ্যস্ত হন।

পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর দায়িত্ব দেন মাস্টারদা। প্রস্তুতির জন্য কল্পনাকে ডেকে পাঠান। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামকে সামরিক এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতি গ্রামেই ছিল সামরিক ক্যাম্প। আত্মগোপনে থাকা অত্যন্ত কঠিন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা ধরা পড়েন। কল্পনা পুলিশের ব্যূহ থেকে পালিয়ে আসেন। প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করতে করতে কল্পনা দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদার, মনোরঞ্জন দত্ত, মনোরঞ্জন দে ও অর্ধেন্দু গুহ সমুদ্রের ধারে গাহিরা নামক গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে কয়েক দিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৯৩৩ সালের ১৯ মে ভোরে সেই গ্রামে রাতে মিলিটারি আক্রমণ করে। বিপ্লবীরাও গুলি চালায়। যুদ্ধ করতে করতে বিপ্লবী মনোরঞ্জন দত্ত নিহত হন। আশ্রয়দাতা পূর্ণ তালুকদারও নিহত হন এবং তাঁর ভাই নিশি তালুকদার আহত হন। বিপ্লবীদের গুলি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই গ্রেপ্তার হন। মিলিটারি সুবেদার কল্পনা দত্তকে চপেটাঘাত করেন। কিন্তু মিলিটারি সৈনিকেরা তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করেন। বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের চোখে লোহার কাটাওয়ালা মিলিটারি বুট দিয়ে এমন লাথি মারে যে তাঁর চোখ দিয়ে রক্তের ধারা পড়তে থাকে। তার ওপর রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হান্টার দিয়ে মারতে থাকে। কল্পনা দত্তকেও হাতকড়া দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়।

এই মামলার নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেস’। এর চার্জ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন, হত্যা প্রভৃতি। এই মামলার আসামি ছিলেন সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত। মামলার রায়ে সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দীপান্তরের আদেশ হয়। অনেক চেষ্টার পর সেই দীপান্তরের আদেশ স্থগিত হয়। মামলার রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ বলেন, ‘মেয়ে বলে এবং বয়স কম বলেই কল্পনা দত্তকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না।’

‘দেশের মানুষ আমাদের জেলে রেখে নিশ্চিন্তে থাকবে না, আমাদের বের করে নিয়ে যাবেই’—এ বদ্ধমূল ধারণা ছিল কল্পনার। ফেলে রাখা অসমাপ্ত কাজ আবার হাতে তুলে নিত হবে। শাস্তি পাওয়ার পরই কলকাতা হিজলি স্পেশাল জেলে কল্পনাকে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই ডিভিশনের বন্দীদের সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিন মাস সেখানে ছিলেন। বইপত্র পড়ার সুযোগ থাকলেও পড়েননি কিছু। অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হয় পরে। তিন-চার বছর পর সব নারী রাজবন্দীদের একত্রে রাখার ব্যবস্থা হয়। সেখানে ‘পরিচয়’ নামের মাসিক পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয়। কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু শুনতেন, জায়াড-এর লেখা, কোলের লেখা বার্নার্ড শ-এর স্যোশালিজম, কমিউনিজম সম্বন্ধে কিছু কিছু বইও তাঁদের কাছ থেকে পেলেন। বইগুলোর যুক্তিতর্ক মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় কল্পনাকে। তিনি দেখলেন, ‘কমিউনিজমের সঙ্গে বিপ্লবীদের মতের কোনো অমিল নেই। কেউ কেউ যখন বলত টেররিস্টদের কমিউনিস্টরা শত্রু বলে মনে করে, হেসে উড়িয়ে দিতেন কল্পনা। দু দলের আদর্শ যখন স্বাধীনতা—তখন পার্থক্য কোথায়?’

রম্যাঁ রঁল্যার ‘আই উইল নট রেস্ট’ বইটি পড়ে রাশিয়ার বিপ্লবের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে তাঁর। লিখেছেন, ‘লেনিনকে পূজা করতে আরম্ভ করলাম।’ তার আগে রম্যাঁ রঁল্যার লেখা ‘সোল এনচান্টেড’ ও ‘জা ক্রিস্তোফ’ বই দুটি পড়ে তাঁর লেখার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালে প্রদেশে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিনা বিচারে রাজবন্দীদের ছেড়ে দেওয়া, রাজনৈতিক বন্দীদের আন্দামান থেকে নিয়ে আসা এবং তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বাইরে জনসাধারণের তুমুল আন্দোলন হয়। বন্দীদের আন্দামান থেকে ফিরিয়ে আনা হয় ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে। ১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে এলেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। এসে শুনলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কল্পনার বাবাকে লেখা একটি চিঠি দেখালেন, ‘তোমার মেয়ের জন্য যা যা আমার করার সাধ্য, তা করেছি। তার শেষ ফল জানবার সময় এখনো হয়নি, আশা করি চেষ্টা ব্যর্থ হবে না।’

রবীন্দ্রনাথের বন্ধু সি এফ এভরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য অপরিসীম পরিশ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গভর্নরের কাছেও গিয়েছিলেন এবং কল্পনার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘কল্পনা যেদিন মুক্তি পাবে, সেদিন যেন তাকে টেলিগ্রাম করা হয়।’ গান্ধীজি কল্পনার বাবাকে বলেছিলেন, সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে চেষ্টা করবেন। তবে ১৯৩৯ সালের ১ মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেল গেটে এলেন কল্পনার বাবা ও মাসতুতো ভাই ঝুমকু (সুবোধ রায়), যিনি বছর খানেক আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। (তিনিও ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের আসামি।)

কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার সাত দিন পরই কল্পনা চলে আসেন চট্টগ্রামে। কমিউনিস্টদের সঙ্গেই কাজ করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন; মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। তিনি জানতে পারেন, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে হলে কোনো একটি গণ-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। তার মধ্য দিয়েই তাঁকে যাচাই করা হবে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কল্পনা উপলব্ধি করেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে নৈতিক শিথিলতার স্থান নেই। আত্মসর্বস্ব ও স্বার্থপরদের কমিউনিস্ট পার্টিতে জায়গা হয় না। এই সত্যও উপলব্ধি করলেন যে, সাম্যবাদই প্রকৃত দেশপ্রেম এবং সেই দেশপ্রেম মানে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা।

১৯৪০ সালে কল্পনা কলকাতায় যান বিএ পরীক্ষা দিতে। জুলাই মাসে বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কল্পনাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে অন্তরীণে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে জাপানি আক্রমণের আশঙ্কায় জাপবিরোধী প্রচারকাজে অংশ নেন কল্পনা। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের (পঞ্চাশের মন্বন্তর) সময় কল্পনার নেতৃত্বে মহিলা সমিতি কাহার সম্প্রদায়ের বিপর্যস্ত মানুষদের সংগঠিত করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মণিকুন্তলা চৌধুরী, জ্যোতি দেবী, পুষ্প সেন, আরতি দত্ত, প্রগতি দস্তিদার, প্রভা দত্ত, শ্রীমতি এ কে খান প্রমুখ। এই বছরেই কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন। বছরের শেষে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে অংশ নেন চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পূর্ণ চাঁদ যোশীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে দেশি-বিদেশি উচ্ছৃঙ্খল সেনাদল চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার কাছাড়পাড়া গ্রামের মুসলিম পাড়ায় আকস্মিক আক্রমণ করে এবং ব্যাপক হারে নারীদের ধর্ষণ করে। সংবাদ পাওয়ামাত্র কল্পনা ছুটে যান এবং পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সাহায্যে কংগ্রেস, মুসলীম লীগ, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সাত দিন হরতাল পালন করা হয়। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ও সেনাবাহিনী পিছু হটে।

১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহিলা আসনে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কল্পনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কংগ্রেসের প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার বিরুদ্ধে। নির্বাচনী সমাবেশে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি দেখে কংগ্রেস ভয় পেয়ে যায় এবং খোদ জহরলাল নেহেরুকে নির্বাচনী প্রচারে আসতে হয়েছিল। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু কল্পনার বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেননি। উপরন্তু ‘বাহাদুর লাড়কী’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

নির্বাচনে কল্পনা জয়লাভ করেননি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হয়। জন্মভূমি ছেড়ে চলে যান ভারতে। কমিউনিস্ট পার্টির কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলেন ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সামতির প্রতিদিনের কাজে। রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে নাম করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের তথ্য সংগ্রাহক হিসেবে যোগ দেন। দেশভাগের পর স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন দুবার ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে। শেষবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন সমব্যথী।

ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনার। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলো গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ১৯৪৫ সালে ‘চিটাগাং আর্মারি রেইডার্স রেমিনিসেন্স’ প্রকাশিত হয় বোম্বাই থেকে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পরিচিত। ১৯৯০ সালে ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’ নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন; শেষ করতে পারেননি। আরও একটি মনোবেদনা নিয়ে চলে গেছেন—তার জীবনের স্মৃতিকথার তিন হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন। দিল্লিতে অটোরিকশায় ভুল করে ফেলে গেছেন, ফিরে পাননি।

১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানী মেমোরিয়াল হাসপাতালে কল্পনা দত্ত যোশীর ৮২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়। তিনি ছিলেন আমৃত্যু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত যোশী একটি চিরস্মরণীয় নাম। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চির জাগরুক হয়ে আছেন এবং থাকবেন। তার জন্মবার্ষিকীতে জানাই রক্তিম অভিনন্দন।