Thank you for trying Sticky AMP!!

সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন

পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ‘বাংলা’ নাকি ‘উর্দু’—কী হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা! পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিষয়টি পূর্ব বাংলার সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত প্রশ্নে রূপ নেয়।

তখনকার সংবাদপত্রে এই বিতর্কের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সংবাদপত্রগুলো পক্ষে-বিপক্ষে নানা প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশ করে ভাষার ইস্যুটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। 

দেশভাগের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা মনোভাব প্রকাশ করতে থাকেন যে একমাত্র উর্দুই হবে নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা।

এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগ-সমর্থক পত্রিকাগুলোয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়।

বাংলা ভাষার পক্ষে তখন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে দৈনিক ইত্তেহাদ। দৈনিক আজাদও বাংলা ভাষার সমর্থনে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপায়।

দেশভাগের আগে ভাষার প্রশ্নে দৈনিক আজাদে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি শুরু থেকেই ছিল রহস্যঘেরা।

আজাদে কখনো বাংলা ভাষার পক্ষে, কখনো বিপক্ষে বক্তব্য প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে পত্রিকাটির কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান ছিল না।

১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়।

১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু?’

শিরোনামে পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। পুস্তিকায় ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের প্রবন্ধও ছিল।

প্রথম থেকেই মর্নিং নিউজ বাংলা ভাষার তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে পত্রিকাটিতে অব্যাহতভাবে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও খবর প্রকাশিত হতো।

১৯৪৭ সালে ১৭ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজের সম্পাদকীয় কলামে উর্দু-সমর্থকদের একটি তাত্ত্বিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তান সরকারের একচোখা নীতির বিষয়ে তমদ্দুন মজলিসের কয়েকজন নেতা তৎকালীন মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে যান।

মন্ত্রী এসব বিষয়কে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে দায় এড়ান। তাঁর এই বক্তব্যের ওপর ইত্তেহাদ ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি তোলেন।

১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকা এই খবর প্রকাশ করে।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে। তাঁর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

সম্পাদকীয়র বক্তব্য বাংলা ভাষার পক্ষে পত্রিকাটির জোরালো সমর্থন নির্দেশ করে। কিন্তু একই বছর মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের সময় পত্রিকাটি সর্বতোভাবে উর্দুকেই সমর্থন করে।

কয়েকটি পত্রিকা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

সংগ্রাম পরিষদে ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবী’ পত্রিকা থেকে তিনজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়।

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তনে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন তিনি। ছাত্ররা ‘না’, ‘না’ বলে প্রতিবাদ জানান।

১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাংলা ভাষাবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না।

বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের চেষ্টা ছিল এই ষড়যন্ত্রের একটি রূপ। ১৯৫০ সালের ২৪ মে দৈনিক আজাদে বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের খবর বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়।

১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে সংগ্রাম পরিষদের পুরোনো কমিটি পুনর্গঠন করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়।

২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। এ পরিস্থিতিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালেই ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। তৎকালীন আমতলায় বসে সভা।

১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে চলে তর্ক-বিতর্ক। একপর্যায়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা আসে। স্লোগান ওঠে, ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন একদল ছাত্রছাত্রী। এরপর দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়।

বিকেলে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। ছাত্রজনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট পুলিশ। শহীদ হন সালাম-বরকত-রফিকসহ নাম না-জানা অনেকেই।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে আগের রহস্যের জাল ছিন্ন করে দৈনিক আজাদ।

এদিন সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদ প্রকাশ করে বিশেষ টেলিগ্রাম। ব্যানার হেডলাইন করা হয়, ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। মুসলিম লীগ সরকার দৈনিক আজাদের এই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে।

পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।

ঘটনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরবর্তী কয়েক দিন দৈনিক আজাদ প্রচুর সংবাদ ছাপে। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা নেয়।

মর্নিং নিউজ ছিল উর্দু ভাষার সমর্থক। পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উগ্র প্রচারণা চালায়।

২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকেও তারা বিকৃত করে ২২ ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করে।

২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অবস্থিত মর্নিং নিউজের প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়। বাংলা ভাষাপ্রেমী জনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয় মর্নিং নিউজ।

সংবাদে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকই ছিলেন বাংলা ভাষার সমর্থক। কিন্তু মালিকানার কারণে পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করছিল।

২১ ফেব্রুয়ারির খবরও পত্রিকাটি খুব কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ক্ষুব্ধ জনতা রথখোলা মোড়ে সংবাদ অফিসে হামলা চালায়।

ভাষা আন্দোলনবিরোধী ভূমিকার জন্য পত্রিকাটি থেকে তরুণ সাংবাদিক মুস্তফা নূরউল ইসলাম ও ফজলে লোহানী পদত্যাগ করেন।
ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হতো।

এ কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভারের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। সম্পাদক আবদুস সালাম ও মালিক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সাপ্তাহিক সৈনিক ২১ ফেব্রুয়ারি বের করে বিশেষ সংখ্যা। পত্রিকাটি লাল কালিতে ব্যানার করে, ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ’।

২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ সৈনিক অফিস ঘেরাও করে। সম্পাদক আবদুল গফুর ও প্রকাশক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইনসাফ ও দৈনিক আমার দেশ।

২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় দৈনিক মিল্লাত ব্যানার শিরোনাম করে: ‘রাতের আঁধারে এত লাশ যায় কোথায়?’।

ঘটনার পর মিল্লাত সম্পাদক মো. মোদাব্বেরের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ভাষা আন্দোলনে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকও জোরালো ভূমিকা পালন করে।

সাইফুল সামিন: সাংবাদিক
saiful.samin@yahoo.com